উৎক্ষেপণের ঠিক ৫৬ মিনিট আগে গলদ ধরা পড়ল চন্দ্রযান-২-এর। আপাতত মিশন স্থগিত রাখা হয়েছে। ইসরো সূত্রের খবর, রকেটের 'ও' রিঙের মধ্যে গলদ ছিল। জ্বালানি ভরার সময় রিংটি ঠিক মতো ফুলে উঠতে পারেনি, তাই জ্বালানি লিক করে বাইরে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। জিএসএলভি-র দুটি চেম্বার স্লাইড প্রপেল্যান্ট চেম্বার এবং লিকুইড প্রপেল্যান্ট চেম্বারের মাঝে রাবারের একটি 'ও' রিং লাগানো থাকে। যাতে রাবার ফুলে উঠে জায়গাটা আরও ব্লক করে দেয়। সেখানে একটা নির্দিষ্ট জায়গা দিয়ে প্রচন্ড চাপে ওই বাষ্প বেরিয়ে আসে এবং রকেটকে ওপরের দিকে ঠেলে তুলতে সাহায্য করে।
ইসরো সূত্রে খবর, সলিড প্রপেল্যান্ট চেম্বারে অগ্নিসংযোগ করার পর নিয়ম মেনে উপরের লিকুইড প্রপেল্যান্ট চেম্বারে জল বাষ্পে পরিণত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু চারপাশে লাগানো 'ও' রিং প্রসারিত না হওয়ার ফলে দুই চেম্বারের মাঝখান থেকে বাষ্প লিক করতে শুরু করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৮৬ সালে এই 'ও' রিং ঠিকমতো কাজ করেনি বলেই উৎক্ষেপণের ১ মিনিট ২৯ সেকেন্ডের মাথায় সাত মহাকাশচারীকে নিয়ে ভেঙে পড়েছিল 'চ্যালেঞ্জার' মহাকাশযান। যা তদন্ত করে জানিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কারজয়ী বিজ্ঞানী ‘রিচার্ড ফাইনম্যান’। তবে যাই হোক, শেষ মুহূর্তে ধরা পড়ায় এ যাত্রায় বড় কোনো অঘটন ঘটেনি, তা সেই সময় কর্মরত বিজ্ঞানীদের দায়িত্বশীলতার পরিচায়ক বলেই মনে করা হচ্ছে। পরবর্তীতে কবে এই অভিযান হবে, তা ইসরোর পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
তবে এই লেখায় আজ আমরা একটু পরিচয় করে নেবো ইসরোর কর্মরত অন্যতম একজন বিজ্ঞানীর সম্বন্ধে। তিনি শুধুই ইসরোর বিজ্ঞানী নন, তাঁর আমাদের কাছে আরো একটি পরিচয় রয়েছে, তিনি হলেন বাঙালি। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমরা গর্বিত, এমন একজন এই মহান কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বলে। ‘চন্দ্রযান-২’ মিশনের ডেপুটি প্রজেক্ট ডিরেক্টর (টেকনিকাল) চন্দ্রকান্ত কুমার| হুগলির ধনিয়াখালী স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে চন্দ্রকান্ত ফিজিক্সে অনার্স পড়তে যান বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনে। রাজাবাজার ইনস্টিটিউট অফ রেডিও ফিজিক্স থেকে এমএসসি এবং পিএইচডি করেন। চন্দ্রযান-১, মঙ্গলযান এবং চন্দ্রযান-২- পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়িয়ে দূরের গন্তব্যে পৌঁছতে ইসরো থেকে বার বার ডাক পড়েছে চন্দ্রকান্তের। প্রয়োজন হয়েছে মহাকাশযানগুলির অ্যান্টেনা তৈরী করতে। তাই বলাই যায়, ইসরোয় পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চন্দ্রকান্তের জীবন চাঁদের তথা চন্দ্রের ছটায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাঁরই নকশায় গড়ে উঠেছে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টেনা। ইসরোর গ্রাউন্ড স্টেশনের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে কথা বলার দরকার পড়ে মহাকাশে থাকা যানগুলির। প্রয়োজন হয় মহাকাশযানগুলি কি জবাব দিচ্ছে তা শোনার, কি বার্তা পাঠাচ্ছে, তা দ্রুত পড়ে দেখার। মহাকাশযানের যে কোনো সমস্যা দেখা দিলে, ইসরোর গ্রাউন্ড স্টেশন তা জানতে পারে ওই অ্যান্টেনার মাধ্যমে। গ্রাউন্ড স্টেশন ওই অ্যান্টেনার মাধ্যমেই বার্তা পেয়ে তার ভিত্তিতে 'ডিকোড' করতে পারে। প্রয়োজনে 'কমান্ড' বা নির্দেশ পাঠাতে পারে। এই অ্যান্টেনা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ধরে তা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পাঠিয়ে দিতে পারে। এই কাজটাই করেন চন্দ্রকান্ত।
তাই বলাই বাহুল্য, অ্যান্টেনা ছাড়া মহাকাশে ওই যানগুলি যেমন অচল, তেমনই মহাকাশযানের অ্যান্টেনা বিগড়ে গেলে বিপদে পড়ে যায় গ্রাউন্ড স্টেশন। কারণ দু'টির যোগাযোগের সূত্রই ওই অ্যান্টেনা। অ্যান্টেনার সঙ্গে আরও দু'টি জিনিস থাকে মহাকাশযানে। একটি রিসিভার, অন্যটি ট্রান্সমিটার। রিসিভার ও ট্রান্সমিটার যাঁরা বানিয়েছেন, তাঁদেরও কাজ দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন চন্দ্রকান্ত। চন্দ্রযান-২-এর একটি 'অরবিটার'( যা চাঁদের বিভিন্ন কক্ষপথে ঘুরবে), একটি 'ল্যান্ডার'(যা চাঁদের কক্ষপথে ঢোকার পর চন্দ্রযান-২-এর শরীর থেকে আলাদা হয়ে এসে নামবে চাঁদের পিঠে বা লুনার সারফেসে) এর নাম 'বিক্রম'। হালকা ছোঁওয়ায় 'সফট ল্যান্ডিং' না হলে তা একেবারেই নষ্ট হয়ে যাবে বা পুড়ে যাবে। ওই ল্যান্ডারের মধ্যেই থাকছে একটি 'রোভার'(যা চাঁদের পিঠ ছোঁওয়ার পর ল্যান্ডারের শরীর থেকে বেরিয়ে এসে চাঁদের বিশেষ কয়েকটি এলাকা বা অংশ ঘুরে বেড়াবে)এর নাম 'প্রজ্ঞান'। এ হেন চন্দ্রযান-২-এর মোট সাতটি অ্যান্টেনা রয়েছে। ল্যান্ডার বিক্রমে রয়েছে একটি। এই সবকটি অ্যানটেনাই চন্দ্রকান্তের বানানো। চন্দ্রযান-১ এর এগারোটি অ্যান্টেনা, মঙ্গলযানের সামনে পেছনে মিলিয়ে চারটি অ্যান্টেনার নকশা থেকে শুরু করে নির্মাণ সবই ছিল চন্দ্রকান্তের বানানো। এইভাবে এই মুহূর্তে ইসরোর প্রকল্পের সাথে বলা ভালো চন্দ্রের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছেন চন্দ্রকান্ত কুমার। চন্দ্রায়ন-২-এর মিশন আপাতত স্তগিত হলেও এই মিশন স্থগিত হবেনা তা বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি 'রিতু কারিধাল' এবং 'এম বনিতা'-এর দুই মহিলাও সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন এই মিশনে। চন্দ্রযান-২-এর মিশন ডিরেক্টরের পদে আছেন ‘রকেট ওম্যান’ রিতু কারিধাল শ্রীবাস্তব। এবং প্রোজেক্ট ডিরেক্টরের পদে আছেন 'বনিতা এম'।