সতীপীঠঃ প্রভাসে রয়েছেন ত্যাগ-বৈরাগ্যে শান্তিদায়িনী মা ‘চন্দ্রভাগা’

গুজরাটের এক মহান পুণ্যভূমি প্রভাস। একত্রে শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণবের প্রধান তীর্থ এই পুণ্যভূমি। ইতিহাসের পথ বেয়ে নানান সময়ে এই তিন ধর্মপথ বিবিধ সংঘাত পেরিয়ে এই ভূমিতেই এসে পেয়েছে সমন্বয়ের তীর্থ। কেননা, এই ভূমির সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে যেমন জড়িয়ে আছে, তেমনি রয়েছে মহাদেব সোমনাথ ও দেবী সতীর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কীভাবে? বলছিঃ

প্রভাসতীর্থ গুজরাটের জুনাগড় জেলায় অবস্থিত। এখানেই ছিল একদা শ্রীকৃষ্ণের আপন নগরী দ্বারকা, শ্রীকৃষ্ণের দেহাবসানের পর যার একাংশ চলে গেছে সমুদ্রের তলায়। এই দ্বারকা-প্রভাসেরই অরণ্যে জরাব্যাধের তিরের আঘাতে শ্রীকৃষ্ণ তনুত্যাগ করেছিলেন। এখানেই তাঁর পার্থিব তনু দাহ করা হয়েছিল। ভক্তজনের মতে, সেই দাহস্থান আজও চিহ্নিত করা যায়। সোমনাথ মন্দিরের পিছনের ভাটকুণ্ড সরোবর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেই নাকি শ্রীকৃষ্ণের দাহকার্য সম্পন্ন করা হয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণের শেষজীবনের সঙ্গে এভাবে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকা প্রভাস, তাই মথুরা-বৃন্দাবনের মতোই বৈষ্ণবসম্প্রদায়ের কাছে যুগ যুগ ধরে হয়ে রয়েছে এক পরম পবিত্র তীর্থ।

শৈবদের কাছে প্রভাস অত্যন্ত আদরের একটি তীর্থ। কেননা, এখানে দেবাদিদেব মহাদেব ‘সোমনাথ’রূপে অধিষ্ঠিত আছেন অলিখিতকাল থেকে। ‘অলিখিতকাল’, কেননা, এখানে মহাদেবের লিঙ্গমূর্তি ও তাঁর আদিমন্দির ঠিক কবে নির্মিত হয়েছিল, তার দিনক্ষণ নির্ণীত হয়নি। আসলে, নির্ণয়ের জন্য সেই আদি মন্দির ও আদি মূর্তি আজ অবশিষ্টই নেই। মুসলিম আক্রমণের মধ্য দিয়ে বার বার এই মন্দির লুন্ঠিত হয়েছে, বিনষ্ট হয়েছে এবং নষ্ট হয়েছে দেবমূর্তিও। এই মন্দিরে মন্দিরের সূচনাকাল থেকেই প্রচুর রত্নসম্ভার সঞ্চয় করে বা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। এমনকি লিঙ্গমূর্তির মধ্যেও রত্ন লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। তাই লুঠেরাদের হাত থেকে মন্দির ও মূর্তি কিছুই রক্ষা পায়নি। সোমনাথ শিবের যে মন্দিরটি বর্তমানে দেখা যায়, সেটি বিগত শতকে রানি অহল্যাবাঈয়ের আনুকূল্যে তৈরি। মন্দিরে শিব মূর্তিতে নয়, লিঙ্গরূপে অধিষ্ঠিত। তবে এই লিঙ্গরূপ সাধারণ নয়, তা স্বয়ম্ভূ জ্যোতির্লিঙ্গ বলেই শাস্ত্রগ্রন্থে কথিত হয়েছে। এর পেছনে একটি পৌরাণিক কাহিনি আছে, যথাঃ

প্রজাপতি দক্ষের অনেকগুলো কন্যার মধ্যে সাতাশটি কন্যাকে একত্রে বিবাহ করেছিলেন চন্দ্রদেব। কিন্তু তাদের মধ্যে চন্দ্র সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন রোহিণীকে। রোহিণীর প্রতি এই ভালোবাসা যত বাড়তে লাগল, অন্যদের প্রতি তাঁর উপেক্ষা ততই স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। সাতাশজনকে অগ্নিসাক্ষী করে বিবাহের মধ্য দিয়ে চন্দ্র সকলকেই সমানভাবে ভালোবাসার অঙ্গীকারে আবদ্ধ। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেটা না-হওয়ায় বাকি ছাব্বিশ স্ত্রী দারুণ ক্ষুন্ন হলেন। তাঁরা বার বার প্রেমভিক্ষা করেও যখন চন্দ্রের মন পেলেন না, তখন অত্যন্ত বিমুখ হয়ে পিতা প্রজাপতির কাছে নালিশ জানাতে গেলেন। কন্যাদের নালিশ শুনে দক্ষ প্রথমে জামাতাকে ডেকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে প্রত্যেককে সমানভাবে ভালোবাসার উপদেশ দিলেন। কিন্তু তাতেও যখন চন্দ্র রোহিণীর মোহ ত্যাগ করলেন না, তখন দক্ষ দারুণ ক্রুদ্ধ হলেন। এবং অভিশাপ দিলেন এই বলে যে, স্ত্রীদের প্রতি পক্ষপাতে অবিচারের কারণে অনিন্দ্যকান্তি চন্দ্র ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্রমে মলিন হয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবেন!

দক্ষের অভিশাপ বিফলে যাবার নয়। তাই দিনে দিনে ক্ষয় ও বিবর্ণ হয়ে চন্দ্র যখন বেশ কাহিল হয়ে পড়লেন, তখন রোহিণীকে নিয়ে গেলেন দক্ষের কাছে ক্ষমা চাইতে। অনেক অনুনয়ে দক্ষ অবশেষে তাঁকে ক্ষমা করে অভিশাপমুক্তির নিদান দিয়ে বললেন যে, ভগবান শিবের আরাধনা করে তাঁকে তুষ্ট করতে পারলে তবেই চন্দ্র শাপের কোপ থেকে মুক্তি পাবেন।

নিদান পেয়ে চন্দ্র এলেন নির্জন দেশ প্রভাসে। সেখানে দিনের পর দিন কঠোর কৃচ্ছ্রের মধ্য দিয়ে তিনি শিবের সাধনা করতে লাগলেন। একদিন সেই সাধনায় শিব তুষ্ট হলেন। সম্মুখে স্বয়ম্ভূ লিঙ্গরূপে আবির্ভূত হয়ে চন্দ্রকে শাপমুক্ত করলেন। আর তাতেই কৃতার্থ হয়ে চন্দ্র তাঁর তপোভূমে এই স্বয়ম্ভূ লিঙ্গরূপী মহাদেবকে শাস্ত্রমতে প্রতিষ্ঠিত করে পূজার সূচনা ও প্রসার ঘটালেন। চন্দ্রের অপর নাম ‘সোম’; তাই তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ ‘সোমেশ্বর’ বা ‘সোমনাথ’ নামে অচিরেই বিখ্যাত হলেন।

বিখ্যাত এই শৈবতীর্থ কীভাবে শাক্ততীর্থ হিসেবেও পরিগণিত হল, তা নিয়েও রয়েছে শাস্ত্রবাক্য। আসলে, সোমনাথ মন্দির থেকে কিছুদূরেই ছিল হিরণ, কপিলা ও সরস্বতী—এই তিন নদীর মিলনস্থল। তাদের এই সঙ্গমস্থলেই পৌরাণিককালে ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে দেবী সতীর উদর পতিত হয়েছিল। দেবীর দেহাংশ এখানে পতনের পরই তা শিলায় পরিণত হয়। বলা বাহুল্য, এর ফলেই এই ভূমি সতীর একান্নপীঠের অন্যতম এক পীঠ হিসেবে জাগ্রত শাক্ততীর্থ হয়ে ওঠে। তন্ত্রগ্রন্থে এই পীঠ সম্পর্কে বলা হয়েছে—

‘উদরঞ্চ প্রভাসে মে চন্দ্রভাগা যশস্বিনী

বক্রতুণ্ড ভৈরবশ্চ।’

শ্লোকটির অর্থঃ প্রভাসে দেবীর উদর পতিত হয়েছিল। দেবী এখানে ‘চন্দ্রভাগা’ নামে বিখ্যাত, তাঁর ভৈরব মহাদেব ‘বক্রতুণ্ড’ নামে পূজিত। এখানে লক্ষণীয় যে, প্রভাসে শিবের ‘সোমনাথ’ নামে যেমন চন্দ্রের কঠোর তপস্যার ইতিবৃত্ত ধরা আছে, তেমনি দেবীর ‘চন্দ্রভাগা’ নামেও চন্দ্রের উপস্থিতিতে সেই ইতিহাসের ছোঁয়া আছে।

যাই হোক, অনুমান করা হয় যে, দেবী সতীর দেহাংশ পতনের স্থান ঘিরে সুন্দর কারুকার্যখচিত এক মন্দির গড়ে উঠেছিল সেই সোমনাথ মন্দিরের সমৃদ্ধির যুগেই। ঠিক কীভাবে কোন সময় দেবীর মন্দির ধ্বংস হয়েছিল, তা জানা যায় না। তবে অনুমান করা যায় যে, সোমনাথ মন্দির লুঠতরাজের কোন একটি পর্বেই দেবীর মন্দিরও ধ্বংস করা হয়েছিল। বিনষ্ট করা হয়েছিল দেবীর মূর্তিও। ফলে, সেই মূর্তি কেমন ছিল, তা আজ আর জানা যায় না। বর্তমানে দেবীর প্রকৃত পীঠ হিসেবে যে স্থানটিকে চিহ্নিত করা হয়, সেই স্থানটিতে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের মাঝে একটি মঞ্চের মতো নির্মাণ অবশিষ্ট আছে। কিন্তু তার গায়ে যেটুকু ভাস্কর্যের চিহ্ন অবশিষ্ট আছে, তাতে অনুমান করা হয়, মন্দিরটি ছিল পুরোপুরি প্রস্তরনির্মিত এবং সেটি ছিল কলানৈপুণ্যের একটি অপূর্ব নিদর্শন। সোমনাথ মন্দির যখন নির্মিত হচ্ছিল রানির মাধ্যমে, তখন শৈব-সন্ন্যাসীরা এই পীঠস্থানকে কোন গুরুত্ব দেননি। ফলে, সেই সময় মন্দিরটি আর পুনর্নির্মিত হয়নি। পরেও হয়নি। বর্তমানে সতীপীঠ হিসেবে যে মন্দিরটি রয়েছে, তা প্রাচীন মন্দিরস্থল সামান্য সরে পৃথকস্থানে অনেক পরবর্তীকালে নির্মিত হয়েছে।

মন্দিরটি আর-পাঁচটা আধুনিককালে নির্মিত চূড়াবিশিষ্ট মন্দিরের মতোই দেখতে। মন্দিরগাত্র হালকা গেরুয়া রঙে রঞ্জিত। মন্দিরের গর্ভগৃহে মূল বেদিতে রয়েছে একটি আদ্যন্ত সিঁদুর মাখানো লম্বা প্রস্তরখণ্ড। তাতে দেবীর দুই চোখ, মুখ ও দেহের কিছুটা আদল খোদিত আছে। সিঁদুরমণ্ডিত দেবীর এই অস্পষ্টমূর্তি যেন ত্যাগ ও বৈরাগ্যের বার্তাই ভক্তজনের মনে সঞ্চার করে। মন্দির ঘিরে শ্রীকৃষ্ণ, মহাদেব, গণেশ প্রভৃতি নানান দেবতার ছোট ছোট মন্দির রয়েছে। গর্ভগৃহের বামদিকের দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে একটি ছোট্ট কৃষ্ণকালিকার মূর্তি আছে। বঙ্গদেশে যে-রূপে কৃষ্ণকালী পূজিতা হন, সেইরকম। এই দেবীও মন্দিরে পূজা পান। তাই হয়তো স্থানীয় মানুষেরা এই মন্দিরকে ‘মহাকালী মন্দির’ নামেও অভিহিত করে থাকেন।

দেবীর মন্দিরে বিভিন্ন পার্বণ উপলক্ষে বিশেষ পুজোয় যেমন, তেমনি নিত্যপুজোতেও ভক্তজনের ঢল নামে। নবরাত্রি ও শিবরাত্রি খুব জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। আসেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অসংখ্য ভক্ত। কার্তিক পূর্ণিমায় সোমনাথ মন্দিরের বিশেষ উৎসব উপলক্ষে যেসব ভক্তজন সমাগত হন, তাঁরা এই মন্দিরেও কৃপাপ্রার্থী হয়ে হাজির হন। এভাবেই প্রসারিত হয় দেবীর অপার্থিব মহিমা।।...   

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...