"পাষাণে ঘটনা যদি অঙ্কিত হইত তবে কতদিনকার কত কথা আমার সোপানে সোপানে পাঠ করিতে পারিতে। পুরাতন কথা যদি শুনিতে চাও তবে আমার এই ধাপে বইস, মনযোগ দিয়া জলকল্লোলে কান পাতিয়া থাকো, বহুদিনকার কত বিস্মৃত কথা শুনিতে পাইবে"...'ঘাটের কথা'- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সত্যিই, একটা তুচ্ছ নদীর ঘাট। হয়তো আজ ভেঙে গেছে তার ধাপগুলো। ময়লায় তার আসল রংও ঢাকা পড়ে গেছে কবে। কিন্তু সেই ঘাটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কতো অজানা কথা, ইতিহাস। আমি এইবারে কলকাতার হুগলি নদীর তীরে তৈরি হওয়া এমন কয়েকটি ঘাটের সম্বন্ধে লিখব যাদের সঙ্গে পুরনো কলকাতার প্রাণের যোগাযোগ ছিল।
সে আর ক'দিন আগের কথা! খুব বেশি তো নয়...তা ধরুন বছর শ' আড়াই আগের। এই কলকাতা শহর তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী এবং ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু তখনও তো ট্রেন চলাচল শুরু হয় নি। তাই ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী, বড়লাট, জজ ম্যাজিস্ট্রেট থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ - সবাই বেশিরভাগ সময় নৌকাতেই যাতায়াত করত। জিনিসপত্র, কাঁচামাল সবকিছুই আমদানি বা রপ্তানি হতো হয় গরুর গাড়িতে নয়তো হুগলি নদীতে নৌকায় বা জাহাজে। আর এই নৌকা চলাচল যাতে সুষ্ঠুভাবে চালানো যায় এবং হুগলি নদীর তীরে এসে দাঁড়াতে পারে সেইজন্যই তৈরি করা হলো কয়েকটা ঘাট। এরকমই একটা ঘাটের কাছে একটা ছোট মুদিদোকান খুলে বসেছিল একজন বাঙালি - নাম চন্দ্রনাথ পাল। যেসব নৌকা ঐ ঘাটে এসে দাঁড়াত, সেই নৌকার মাঝিরা তার দোকানে বসে দু'দন্ড বিশ্রাম নিত, হুঁকো টানতো। চিঁড়ে বা মুড়িমুড়কি আর জল খেয়ে আবার নৌকা নিয়ে রওনা দিত অন্য গন্তব্যে। এই চন্দ্রনাথ পাল - লোকমুখে গিয়ে দাঁড়ালো "চাঁদ পাল"...আর কথিত আছে এই মানুষটির নামেই সেই ঘাটের নাম হল 'চাঁদপাল ঘাট'...সম্ভবত কলকাতার সবচেয়ে পুরনো ঘাট। কারণ ১৭৭৪ সালের কলকাতার ইতিহাসে এই ঘাটের নাম উল্লিখিত হয়েছে।
১৭৭৩ সালে কলকাতায় স্থাপিত হয় পার্লামেন্টের 'গভর্নর জেনারেল সুপ্রিম কাউন্সিল' এবং 'সুপ্রিম কোর্ট'... (হ্যাঁ, ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হওয়ার কারণে সুপ্রিম কোর্ট কলকাতাতেই স্থাপন করা হয়েছিল)। পাঠকরা ভাবছেন তো তার সাথে চাঁদপাল ঘাটের সম্পর্ক কী? আছে আছে... কারণ ঠিক এর এক বছর পর ১৭৭৪-এর ১৯শে অক্টোবরে দুপুর বেলায় এক সাহেবী নৌকা এসে এই ঘাটেই থামল এবং সেই নৌকা থেকে নেমে এলেন স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস, লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্যার জন ক্লেভারিং, কর্নেল মনসন, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার এলিজা ইম্পে এবং তিনজন সহকারী বিচারপতি জন হাইড, রবার্ট চেম্বার্স ও স্টিফেন সিজার লিমেস্টার। কলকাতার এই নদী ঘাটের নাম ইতিহাসের পাতায় উঠে গেল। এর পর থেকে রেলপথ চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত ভারতে যত বড়লাট, সেনাপতি, বিশপ, বিচারপতিরা ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন, তাঁরা প্রত্যেকে এই ঘাটেই নেমেছেন। এই চাঁদপাল ঘাটই হয়ে উঠেছিল কলকাতার প্রধান জাহাজঘাটা। বিদেশ থেকে যতো রাজকর্মচারীদের জাহাজ..সব এসে এই ঘাটেই ভিড়ত।
এরপর রেল যোগাযোগ চালু হলো। হাওড়া স্টেশন তৈরি করা হলো। আর ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাতে থাকলো চাঁদপাল ঘাট। জাহাজ চলাচলও আস্তে আস্তে কমতে থাকলো। তারপর জাহাজ আসা বন্ধ হয়ে গেলে ফেরি সার্ভিস চালু করা হলো। কিন্তু চাঁদপাল ঘাটের পাশ দিয়েই রেললাইন তৈরি হলো যার উপর দিয়ে কলকাতা বন্দরগামী মালগাড়ির যাতায়াত শুরু হলো। নৌকার গুরুত্বও কমে গেল। বর্তমানে ফেরি সার্ভিস চালু থাকলেও সেই পুরনো গৌরব আজ আর চাঁদপাল ঘাটের নেই।
তবুও, এই ঘাটে এসে কিছুক্ষণ সময় থাকলে যেন ইতিহাস মূর্ত হয়ে ওঠে। গঙ্গার জলকল্লোল যেন কানে কানে বলে যায় "এই ঘাটকে ভুলো না তোমরা। এই কলকাতার চাঁদপাল ঘাটেই লন্ডন থেকে একশো পঁয়তাল্লিশ দিন ভারত মহাসাগর, সমুদ্র যে বহু নদী পাড়ি দিয়ে এসে ভিড়েছিল ‘এন্টারপ্রাইজ’...এই গঙ্গার ইতিহাসে প্রথম বাষ্পীয় জাহাজ..."