কোচবিহারের ফালাকাটায় বর্ষা হলে ভেসে যেত দিগন্ত বিস্তৃত খেত। আশেপাশের এলাকার সব জল এসে জমা হত একটা নির্দিষ্ট জায়গায়। সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি থেকে বেরোনোর উপায় থাকত না। পথে একটা জায়গায় আশ্রয় নেওয়ার ছাউনি ছিল। সেই ছাউনিতে দাঁড়িয়েছিলেন স্থানীয় ব্যক্তি ভবেন রায়। তিনি হঠাৎ করে দেখলেন এক বয়স্কা মহিলা তাঁকে ডাকছে। বৃষ্টিতে চুপচুপে ভিজে এক মহিলা ছাউনির বাইরে দাঁড়িয়ে ভাবেনবাবুকে অনুরোধ করছেন যে তাঁকে টেনে ছাউনির ওপর তুলতে। প্রায় এক গলা জলে ডুবে আছেন তিনি। সেই বয়স্কা মহিলা খুশি হয়ে ভবেন রায়ের সঙ্গে নিজের নাতনির বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
ভবেন রায় দারুণ খুশি। একা মানুষ, পরিবারে কেউ নেই। বুড়ির কথায় ভবেন রায় এক পায়ে খাড়া। বুড়িকে সবেমাত্র নিজের সম্মতির কথা জানাতে যাবেন, ঠিক তখনই ভবেন রায় দেখেন বুড়ি অদৃশ্য। চোখের নিমেষে মানুষটা হাওয়ায় মিশে গেছেন। বৃষ্টিতে চুপচুপে ভিজে এক বয়স্কা মহিলা এইভাবে উধাও হয়ে গেল কোথায়! একটা চিনচিনে ভয় ভবেন রায়কে ঘিরে ধরতে শুরু করে। গা-হাত-পা অবশ হয়ে যায়। বুকের ধুকপুকুনিটা বাড়তে থাকে। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না। এরপর থেকেই তাঁর জ্বর আসে। একেবারে বেহুঁশ করে দেওয়া জ্বর। জ্বর গায়ে ভবেন রায়ের টনক নড়ে। তিনি বুঝতে পারেন তিনি আসলে চাঁদনী কুড়ার চাঁদনী দেবীকে দেখেছেন।
পরের দিন ভবের রায় চাঁদনী দেবীর থানে গিয়ে মানত করে আসেন। মানত করা মাত্রই জ্বর সেরে যায়। তিনি বুঝতে পারেন চাঁদনী কুড়ার চাঁদনী দেবী তাঁকে দেখা দিয়েছিলেন। আলিপুরদুয়ার জেলার ফালাকাটা ব্লকের যোগেন্দ্রপুরের কৈমারী বিল নিয়েও ঠিক এমন একটি জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। যেখানে উদযাপিত হয় মানবিকতা, মমত্ব আর সহানুভূতি।
ঝাড়খণ্ডের করথানের করো গ্রামে এমনই একটি মমতার গল্প শোনা যায়। যেখানে মানবিকতার পরীক্ষা দিয়েছিলেন স্থানীয় এক গ্রামের ব্যক্তি। আলিপুরদুয়ারের ফালাকাটার ধনীরামপুর-দুই গ্রামে রয়েছে একটি কুড়া। গাছ-গাছালি বাঁক নিয়ে একটি কুড়া তৈরি হয়েছিল ওখানে। মাঝখানে ছিল একটি গর্ত। গর্তে ডুডুয়া নদীর জল আর চারপাশে ডাঙ্গা। এখানেই রয়েছে চাঁদনী কুড়া। স্থানীয় ভাষায় অপভ্রংশের পর এর নাম হয় চাঁন্নী-কুল্লা। চাঁদনী কুড়ার পাশেই রয়েছে এখানকার লোকদেবী চাঁদনী দেবীর স্থান।
মূলত বয়স্কা বুড়ি হিসেবে কল্পনা করা হয় এই দেবতাকে। মূর্তিতেও তেমন ছাপ স্পষ্ট থাকে। তবে জনশ্রুতি এমন যে এই চাঁদনী দেবী যাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হন তাকেই নাকি নিজের নাতনির সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। তাই দেবীর দুপাশে দুই নাতনি থাকে। এই নাতনিদের গায়ের রং গোলাপি। চাঁদনী দেবীর নিজের গায়ের রং সাদা। এই দেবীর বাহন কচ্ছপ। রাজবংশী ভাষায় কচ্ছপকে পানি মাছ বলা হয়। চাঁদনী বুড়ির পরনে সাদা শাড়ি। খোলা চুল। এক হাতে একটা লাঠি ধরা। জনশ্রুতি রয়েছে যে চাঁদনী বুড়ি তার দুই নাতনিকে কখনো গভীর রাতে থানের আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেন না। চাঁদনী দেবী নাকি পুজো পাওয়ার জন্য গ্রামের লোকেদের গরু, বাছুর লুকিয়ে রাখেন। মানত করলেই হারানো গরু, বাছুর ফিরিয়ে দেন। চাঁদনী দেবী কাউকে শাস্তি দেন না, কারোর অনিষ্ট করেন না। ছদ্মবেশে এসে মানবিকতার পরীক্ষা নেন।
প্রতিবছর দুর্গাপুজোর সময় এই দেবতার পুজো করা হয়। দুর্গাপুজোর সময় চাঁদনী দেবীর পুজো না হলে পরিবর্তে সে বছর চড়ক পুজোর সময় পুজো করা হয়। পুজোর উপকরণ বলতে দুধ, দই, চিড়ে, ফলমূল এছাড়া কারণ মানত থাকলে মানত অনুযায়ী পায়রা বা পাঁঠা বলি দেওয়া হয। তবে সরাসরি বলি প্রথা নেই। পাঁঠা বা পায়রা ঠাকুরের কাছে উৎসর্গ করে দেওয়া হয়।
এই পুজো রাজবংশী সম্প্রদায়ের লোকেদের হলেও পূজারী কিন্তু ব্রাহ্মণ। যেহেতু চাঁদনী দেবীর মূর্তি তৈরি করে পুজো করা হয় তাই ব্রাহ্মণ পুজো করেন। রাজবংশী সমাজে একাধিক লোকদেবীর মূর্তি পুজোর প্রচলন রয়েছে। এইখানে পুজো করেন মানিক দেব শর্মা। এছাড়া কখনো অন্যান্য পুরোহিতকে দিয়েও পুজো করানো হয়। পুজোর উপকরণ খুব সামান্য। দই, ফলমূল, চিড়ে, দুধ ইত্যাদি। এই দেবীকে সকলে ভালোবাসা, সহানুভূতির দেবতা মানেন। ওই অঞ্চলে এই দেবী তাই সকলের আপনজন।