মনোহর ডাকাতের ছানা কালী

আজ কালীকথায় ফের একবার ডাকাতের আরাধ্যা কালীর কথা। উত্তর কলকাতায় সেই সময় ত্রাস ছিলেন রঘু ডাকাত। আর দক্ষিণে ছিল মনোহর ডাকাতের ডেরা। বাংলার অত্যাচারী জমিদারদের সম্পত্তি লুঠ করা এবং কালী পুজো করা; এই ছিল বাংলার ডাকাতদের ইউইসপি। মনোহরও তার ব্যতিক্রম নয়! সেকালের বাংলার নাম করা জমিদারেরা মনোহরের নামে কাঁপতেন। ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে দক্ষিণ কলকাতার এই বাড়িতে বসেই চলত কালী সাধনা। পরে রক্ত দিয়ে চিঠি লিখে কবে, কখন ডাকাতি হবে তা আগাম জমিদারের বাড়িতে চিঠি দিয়ে জানানো হত। সঙ্গে থাকত হুমকি, 'আটকাতে পাড়লে আটকে নে। শুধুই যে বাংলার অত্যাচারী জমিদারের রাতের ঘুম কেড়েছিল মনোহর, তা নয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিরও রাতের ঘুম কেড়েছিল মনোহর। তাকে জব্দ করতে সুদূর ইংল্যান্ড থেকে বিশেষ তদন্তকারীদের দল আনা হয়েছিল৷ তবে কোনও লাভ হয়নি৷

সেই সময় দেশে ইংরেজ শাসন। সেই সময়ই কলকাতা শহরের বুকে মনোহর প্রতিষ্ঠা করেন কালী মন্দির৷ সেই থেকে এই ডাকাত কালীবাড়িতে পুজো হয়ে আসছে আজও।

কলকাতার যেখানে তিনি এই কালী মন্দিরটি করেছিলেন, তারও ইতিহাস রয়েছে। সেই সময় দক্ষিণ কলকাতার মনোহর পুকুর রোড ছিল জঙ্গলে ঘেরা। সেখানেই ছিল মনোহরের বাস। সেখানে একটি কুয়ো থেকে মনোহর পেয়েছিল একটি কালীমূর্তি। তাই মন্দিরে বসিয়ে পুজো শুরু হয়। মনোহর ডাকাতের প্রতিষ্ঠা করা কালীবাড়িতে প্রতিবছর নিয়ম মেনে পুজো হয়ে আসছে আজও৷ ভিড় জমান ভক্তরাও৷ ​দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাটের ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের পাশেই রয়েছে এই মন্দির। চারদিকে সুদৃশ্য ঝাঁ চকচকে বাড়িঘরের আড়ালে এক প্রকার ঢাকাই পড়ে থাকে এই মন্দির। কিন্তু এই ছোট মন্দিরটির আড়ালেই রয়েছে এক ভয়ঙ্কর গা ছমছমে ইতিহাস। হবে নাই বা কেনও, এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতার নাম যে মনোহর ডাকাত।

মনোহর বাগদি। যার নামে কলকাতার এই অঞ্চলটির নাম মনোহরপুকুর রোড হয়েছিল, যদিও বর্তমানে নাম বদল হয়ে হয়েছে পূর্ণদাস রোড। পলাশীর যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। তখনও বাংলায় কোম্পানি শাসন শুরু হয়নি। সেই সময় কলকাতার দক্ষিণের সম্পূর্ণ গভীর জঙ্গলে ভরা এলাকার মধ্যে দিয়ে বয়ে যায় আদিগঙ্গা। সেই জঙ্গলের গভীরে ছিল সেই সময়ের দুর্ধর্ষ ডাকাত মনোহর বাগদীর ডেরা। এমন তার দৌরাত্ম্য যে স্থানীয় জমিদারদের পাশাপাশি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকেও নাজেহাল করে ছেড়েছিল।

শোনা যায়, একদিন মাঝরাতে মনোহর আর তার দলবল ডাকাতি করে ফেরার সময় দেখতে পায় জঙ্গলের মধ্যে বাঘের আক্রমণে আহত এক মহিলা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। পাশেই রয়েছে তার ছোট্ট শিশু। শিশুর কান্নায় মন গলিয়েছিল মনোহরের। দুজনকেই মনোহর তার ডেরায় নিয়ে এসে সেবা শুশ্রুষা শুরু করে। কিন্তু মহিলাটিকে বাঁচানো যায়নি। এদিকে ডাকাত সর্দার মা হারা সেই শিশুটিকে নিয়ে পড়ল মহা বিপদে। শেষে সন্তানহীন মনোহর তাকে নিজের কাছেই রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। বাচ্চাটির নামকরণ করে হারাধন। এখান থেকেই দস্যু মনোহরের বাল্মীকি হয়ে ওঠার শুরু। যত স্নেহ বাড়তে থাকে ততই তার ডাকাতির ইচ্ছে চলে যেতে শুরু হয়। হারাধনকে সে ভর্তি করে ভবানীপুরের খ্রিস্টান পাঠশালায়। হারাধনের সম্পূর্ণ নাম হল হারাধন বিশ্বাস।

হারাধন ছিল অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ধীরে ধীরে বৃদ্ধ ও জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ে মনোহর। কোম্পানির শাসনে ডাকাতি করাও মুশকিল হয়ে ওঠে। চোখের মণি হারাধনের কাছে নিজের পেশাও গোপন রেখেছিল সে। ধীরে ধীরে নিজেক পেশার কারণে অনুতাপ জন্মানো মনোহর শেষ জীবনে চাষবাস করে জীবন অতিবাহিত করতে থাকে। ডাকাতি করে রোজগার করা তিন ঘড়া মোহর আর আরও সোনা-রুপো ছেলেকে দিয়ে যান মনোহর। তবে হারাধনকে জানায় এসব সে গুপ্তধন হিসেবে পেয়েছিল। দক্ষিণ কলকাতার ওই অঞ্চলে সেসময় গ্রীষ্মকালে দারুণ জলকষ্ট থাকত। মৃত্যুর আগে ছেলেকে ধনসম্পত্তি দিয়ে মনোহর ইচ্ছা প্রকাশ করে হারাধন যেন ওই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি জলাশয় তৈরি করে। সে কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল হারাধন।

সাধারণত জঙ্গলের পথে কালীঘাটের মন্দির দর্শন করতে যাওয়া পুণ্যার্থীদের লুঠ করত মনোহর। ডাকাতির আগে একটি কষ্টিপাথরের মূর্তিকে কালীজ্ঞানে পুজো করত মনোহর। বর্তমান কালীমন্দিরটির বাইরে একটি ছোট্ট লাল মন্দির রয়েছে সেখানেই ওই কষ্টি পাথরটি রেখে পুজো করত সে। মনোহরের সেই মূর্তিটিই আজও এই কালী মন্দিরের প্রধান বিগ্রহ হিসেবে পুজিত হয়। তবে কথিত আছে যে প্রতিদিন ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে মনোহর এই পুজো করার পর মূর্তিটি দড়ি বেঁধে ডেরার পাশের একটি পাতকুয়োতে ফেলে দিত। যাতে কেউ তা হস্তগত করতে না পারে।

মনোহরের মারা যাওয়ার পর দীর্ঘদিন সেই মূর্তিটি পাতকুয়োতেই অরক্ষিত অবস্থায় পড়েছিল। এরপর স্থানীয় এক বাসিন্দা জনৈক কামাক্ষা চরণ মুখোপাধ্যায় একদিন দেবীর স্বপ্নাদেশ পান, যে দেবী দীর্ঘদিন পাতকুয়োয় পড়ে আছেন, নিত্যপুজো পান না। কামাক্ষা যেন দেবীকে প্রতিষ্ঠা করে দেবীর নিত্য পুজোর ব্যবস্থা করেন। পাতকুয়ো থেকে উদ্ধারের সময় এই কালী মূর্তির গায়ে কোনও অলঙ্কার ছিল না। দেবী ছিলেন আয়ুধভূষিতা। গলায় ছিল কঙ্কালের মালা, আর হাতে আসল মানুষের মাথার খুলি। আকৃতিতে ছোট হলেও এই কালীর রূপ ভয়াল। দক্ষিণ কলকাতার কংক্রিটের জঙ্গলে ঘেরা এই মন্দিরের পরিবেশ এতই শান্ত যে আজও এই মন্দিরে পা দিলে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে পারে। তবে অনেক মানুষের মতে এটি এশিয়ার সবচেয়ে ছোট কালীমূর্তিও বটে। এরপরই কামাক্ষাবাবু বর্তমান মন্দিরটি তৈরি করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু যেহেতু এই দেবীর প্রকৃত পুজারি ছিল মনোহর ডাকাত, তাই তার নাম অনুসারেই এই মন্দিরের নাম হয় মনোহর ডাকাতের ছানা কালী। ছানা কালী কারণ মূর্তিটির আকৃতি খুবই ছোট। আর তা থেকেই মনোহরের ছানা কালী নামের উৎপত্তি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...