অবকাশ যাপন যদি বেহিসেবি হয় তার আনন্দ আলাদা। চক্রাতা এমন একটি স্পট যার নাম অনেকের কাছেই অজানা। আর অজানা, অচেনাকে চেনা জানার জন্যই মানুষ বেরিয়ে পড়ে লোটা কম্বল নিয়ে। বাঙালিরা হুজুগে তাই তাদের কাছে আর অধরা বলে কিছু নেই। মন পরিযায়ী হলে কোথাও না কোথাও বেরিয়ে পড়তে মানা নেই। তাই আমরা বেরিয়ে বেরিয়ে পড়ি কাছে দূরে, নীল নির্জনে।
কয়েক বছর আগে এমনই এক পুজোতে গন্তব্য ছিল চক্রাতা। পাহাড়ের রানী বলা হয় এই শৈল শহরকে। আমরা স্বামী স্ত্রী আর ছেলে, সঙ্গে আমাদের সহযাত্রী হলেন ভাসুর আর তার পরিবারের তিনজন। টিকিট কাটার পর তিনমাস অতিক্রান্ত হলেই বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে চলা শুরু। হরিদ্বারে পৌঁছে দু’দিন বিশ্রাম। এর মধ্যে হরিদ্বার থেকেই একটি গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়। এই গাড়িটি থাকে আমাদের সফরকালীন যান। এরপর পাহাড়ের পাকদন্ডী বেয়ে রওয়ানা।
সেবারে বেরিয়ে পড়েছিলাম অক্টোবরের শেষের দিকে। শীত পড়তে শুরু করেছে। হিমেল হাওয়ার ঠান্ডা স্পর্শ গায়ে লাগছে। পাহাড়ে শীত আরও বেশি। গাড়ি নিয়ে পাহাড়ের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম মুসৌরির কাছে কেম্পটি ফলস। কেম্পটি থেকে পনের কিলোমিটার এগিয়ে গেলে যমুনা পুল। যমুনা পুল দিয়ে দক্ষিণ পশ্চিমে এগিয়ে যাওয়া আরো ঊনত্রিশ কিলোমিটার।
গাড়োয়ালের জৌনসারি উপজাতিদের বাসভূমি চক্রাতা। কৈলানা পর্বতমালায় প্রায় দু হাজার মিটার উঁচুতে এক রোডোডেনড্রোন, ওক, পাইন ফার গাছে ছাওয়া নির্জন শৈলাবাস চক্রাতা। সম্পূর্ণ সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় একসময় এখানে পর্যটকরা ব্রাত্য ছিল। বর্তমানে প্রচুর পর্যটক সমাগম হয়। বর্তমানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্পেশ্যাল ফোর্সের একটি শাখাকেন্দ্র এটি।
সমতল থেকে সাড়ে সাত হাজার ফুটের উপরে অবস্থিত চক্রাতা। কাঁটায় কাঁটায় বিকেল পাঁচটার ভেতরে এখানে ঢুকে পড়তে হয়। অসাধারণ নৈসর্গিক শোভায় শোভিত। চক্রাতার চারিদিকে বিভিন্ন ভিউ পয়েন্ট থাকলেও চক্রাতায় বসেই সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের শোভা দেখা যায়। এখানেই পশ্চিম গাড়োয়াল পর্বতমালা শেষ হওয়ার পর শিবালিক রেঞ্জ শুরু হয় তাই প্রকৃতিতেও বৈচিত্র্যের ছোঁয়া।
সবুজ পাইন বন আর হলুদ কালো পর্বতমালার অদ্ভুত সৌন্দর্য মিলেমিশে একাকার। শীতের সময় বরফে মোড়া থাকে। তখন আদর্শ স্কি করার স্পট হিসেবে মর্যাদা পায়। চারিদিকে পর্বতমালার শোভা আর নানা ধরণের বিচিত্র গাছগাছালি, ফুলে ফুলে ঢাকা চক্রাতা ।
থাকার জায়গা বলতে হোটেল স্নো ভিউ আর দু একটা হোটেল আছে। তবে সবচেয়ে প্রাচীন হোটেল স্নো ভিউ। সাহেবি আমলের। চিমনি বসানো ফায়ার প্লেস, আর পাথর দিয়ে গড়া বাংলোবাড়ি। প্রচুর বিদেশি সমাগম হয় নৈসর্গিক টানে। দ্রষ্টব্য বলতে টাইগার ফলস, দেওবন, চক্রাতা থেকে তিন কিলোমিটার দূরে খারাম্বা চূড়া, দুই কিলোমিটার দূরে চিরিমিরি লেক, চিরিমিরি থেকে এক কিলোমিটার চড়াই উঠে থানাডান্ডা, ছয় কিলোমিটার দূরে রামতাল গার্ডেন।
চক্রাতা থেকে গাড়ি করে আধ ঘন্টার রাস্তা গিয়ে পায়ে হেঁটে পুরো পাহাড়কে অতিক্রম করলে দুটো পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়ে থাকা ৩০০ ফুট উচ্চতা থেকে ঝরে পড়া দুরন্ত পাহাড়ি ঝর্ণা টাইগার ফলস। অসাধারণ ঝর্ণাটির সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হতেই হয়। চক্রাতার ঠিক উপরেই দশ কিলোমিটার পায়ে হাঁটা পথে দেওবন। দেওদার গাছে ছাওয়া অপূর্ব নৈসর্গিক ক্যানভাস। দেবতাদের বন অথবা দেওদার গাছে ছাওয়া বলেই হয়তো এর নাম দেওবন। শিরশিরে বাতাস, পাতায় পাতায় ফিসফাস শব্দ দূরে শৃঙ্গমালার সারি নিয়ে নীরব নিস্তব্ধ দেওবন। ঢেউখেলানো পাহাড়ের উপরে চালচিত্রের মতো পটে আঁকা দূরে বান্দরপুঁছ আর স্বর্গারোহিনী, হিমালয়ের শৃঙ্গরাজি সজ্জিত ।
খাওয়া দাওয়া সাদামাটা। তবে এখানকার পরোটার স্বাদ একেবারে আলাদা। প্রত্যন্ত এলাকায় বাহারি খাদ্যের আশা করা বাতুলতা। ভাত হলে অবশ্যই দেরাদুন চালের ভাতের ঘ্রানে চিকেন বা আন্ডা-কারি জুটে যায় আর পাহাড়ি শীতে গরমাগরম আন্ডাকারি দিয়ে দেরাদুন রাইস জমে ক্ষীর।
ম্যাগি, চাউমিন আজ ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে গিয়েছে। ডাল ভাত, রুটি পরোটার দেশে নিঃশব্দে এই খাদ্য (পড়ুন চীনা খাদ্য) বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
দুটো রাত চক্রাতায় কাটিয়ে আরেক শৈলরানীর দরবারে যাওয়ার তোড়জোড়। গাড়ি ছুটে চলেছে মুসৌরির দিকে চেনা পথে।