কালী কথা: মুক্তকেশী কালী মন্দির, যে মন্দিরে মাতৃ আরাধনা করেছেন পরমহংসদেব

শক্তি সাধনার ওতপ্রোতভাবে যুক্ত দেবী কালিকার আরাধনা। শাক্তরা বিশ্বাস করেন, স্বয়ং শিব তন্ত্রসাধনার জন্ম দিয়েছিলেন। আর শক্তির আধার হলেন মা কালিকা। সেই সাধনাই শক্তিরূপে জগতের কল্যাণের জন্য আত্মপ্রকাশ করেছে। বাংলা শক্তি সাধনা বরাবরই নানারূপে হয়েছে। তান্ত্রিক সাধকদের সাধনক্ষেত্র হিসেবে বঙ্গের বিভিন্ন পীঠস্থান খ্যাতি লাভ করেছে। এই'সব পীঠস্থান ঘিরে রয়েছে কোনও না-কোনও জনশ্রুতি। 

ওঁ খড়্গং চক্রগদেষুচাপপরিঘান শূলং ভুসূণ্ডিং শিরঃ

শঙ্খং সন্দধতীং করৈস্ত্রিনয়নাং সর্বাঙ্গভূষাবৃতাম্।। 

নীলাশ্মদ্যুতিমাস্যপাদদশকাং সেবে মহাকালিকাম্। 

যামস্তৌচ্ছয়িতে হরৌ কমলজো হন্তুং মধুং কৈটভম্ ।।

ব্রহ্মযামল মতে, কালী বাংলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কালী বিভিন্ন রূপভেদে এই বিপুলাবঙ্গে বিরাজ করছেন। যেমন রয়েছে, দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, চামুণ্ডা ইত্যাদি। আবার কোনও কোনও মন্দিরে তিনি ব্রহ্মময়ী, ভবতারিণী, আবার কোথাও আনন্দময়ী, করুণাময়ী। নানাবিধ নামে কালীপ্রতিমা প্রতিষ্ঠিত ও নিত্য পূজিত। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালীপুজো, এটি কালী আরাধনার সর্ব বৃহদ উৎসব। এছাড়াও মাঘ মাসে রটন্তী কালী পুজো ও জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যায় ফলহারিণী কালীপুজোও রয়েছে। কলকাতার জুড়ে ছড়িয়ে আছে অজস্র মন্দির কালীঘাট মন্দির, দক্ষিণেশ্বর, আদ্যাপীঠ, ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি, ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি ইত্যাদি। 

তেমনই এক কালী পীঠস্থান হল মা মুক্তকেশীর কালী মন্দির। চৈতন্যপূর্বযুগের তান্ত্রিক সাধকদের সাধন-ক্ষেত্র ছিল আড়িয়াদহ শ্মশান। ​চৈতন্যদেবেরও প্রাককাল থেকে এই মুক্তকেশী মন্দির বিখ্যাত। প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে থেকে এই কালী মন্দির এবং মন্দির সংলগ্ন আড়িয়াদহ শ্মশান তান্ত্রিক-সাধকদের সাধনক্ষেত্র হিসেবে বিখ্যাত হয়েছে। শোনা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণের মায়ের শেষকৃত্য এই শ্মশানেই সম্পন্ন হয়েছিল। এই শ্মশানের কাছেই রয়েছে মুক্তকেশী কালী মন্দির। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই মন্দিরে আসতেন। এই মন্দিরে পুরোহিতের আসনে বসে তিনি দেবীর পুজোও করেছেন। আড়িয়াদহে গঙ্গার ফেরি ঘাটের কাছে এই শ্মশান ও মন্দির। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, দেবী মুক্তকেশী অত্যন্ত জাগ্রত। তিনি ভক্তের কামনা, বাসনা পূরণ করেন। ভক্তদের শান্তি দেন, স্বস্তি দেন। 

এককালে এই মন্দির ছিল তালপাতার। তারপর ১২৪৭ বঙ্গাব্দে পাকা মন্দির গড়া হয়। মন্দিরটি পশ্চিমমুখী, কিন্তু মন্দিরের অর্থাৎ দেবী কালিকার গর্ভগৃহ দক্ষিণমুখী। কার্তিক অমাবস্যায় এই মন্দিরে জাঁকজমোকপূর্নভাবে শ্যামা পুজো আয়োজিত হয়। এছাড়াও দুর্গা পুজোর সময় বিশেষ পুজো হয়। মুক্তকেশী মন্দিরে অক্ষয় তৃতীয় ও অন্নকূট উৎসব পালিত হয়। মন্দিরে বলির চল রয়েছে। একদা এখানে পাঁঠা বলি হত। কালের নিয়মে আজকাল পাঠা বলিতে ছেদ পড়েছে, অধুনা চালকুমড়া, আখ, কলা ইত্যাদি বলি দেওয়া হয়। নিত্যপুজো চলে।

বছরের তিন সময়ে এখানে দেবীকে তিন রূপে পুজো করা হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণী অমাবস্যায় আয়োজিত হয় ফলহারিণী কালী পুজো। কার্তিক মাসে হয় দীপান্বিতা কালী পুজো এবং মাঘ মাসের কৃষ্ণ চতুর্থীতে রটন্তী কালী পুজোও এখানে মহাসমারোহে আয়োজিত হয়। শক্তিপীঠের পীঠ রক্ষক বা মন্দিরের ভৈরব হলেন শান্তিনাথ। শিবলিঙ্গ রূপে নিত্য পুজো করা হয়। মুক্তকেশী কালী মন্দিরের  বিপরীত দিকে, শ্মশানের পাশেই রয়েছে দক্ষিণেশ্বর বুড়ো শিবের মন্দির। কথায় বলে, বুড়ো শিব স্বয়ম্ভূ। জনশ্রুতি রয়েছে, রাজা হোসেন  শাহের আমলে কোনও এক ব্রাহ্মণ শিবের স্বপ্নাদেশ পান। স্বপ্নে দেবাদীদেব মহাদেব নাকি তাকে বলেন, শিব বহুদিন ধরে গঙ্গার ধারে  জঙ্গলের মধ্যে পড়ে রয়েহেন। এবার তার পুজোর ব্যবস্থা করতে হবে। এই স্বপ্নের পরদিন ওই ব্রাহ্মণ গঙ্গার ধারে গিয়ে দেখেন সত্যি সত্যিই সেখানে একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে। তারপর ওই ব্রাহ্মণ শিবলিঙ্গটিকে নিয়ে এসে ফের প্রতিষ্ঠা করেন। এই শিবলিঙ্গ নিয়ে কিংবদন্তির শেষ নেই। শোনা যায়, বড়লাট লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস ভারতের বিভিন্ন প্রাচীন কীর্তির বিবরণ সংগ্রহ করার সময় লোকমুখে এই কাহিনী শুনে কৌতূহলী হয়ে শিবলিঙ্গটিকে পরীক্ষা করার জন্য মাটি খোঁড়েন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তিনি শিবলিঙ্গটির তল  পাননি। মন্দিরের একটি ফলক থেকে জানা যায়, বান রাজার আমলে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...