নদীয়ার শান্তিপুরের অন্যতম প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ পারিবারিক কালীপুজো হল চাঁদুনীবাড়ির কালীপুজো। এই পুজো শুরু করেন গোপীনাথ সার্বভৌম। শান্তিপুর ছিল বর্ধিষ্ণু জনপদ৷ প্রবাহিত গঙ্গার পাড়ে একটি কুটিরে বাস করতেন গোপীনাথ সার্বভৌম। কথিত রয়েছে, এক রাতে গোপীনাথ মায়ের স্বপ্নাদেশ পান৷ স্বপ্নাদেশে তিনি জানতে পারেন তাঁর স্ত্রীকে মা সিদ্ধেশ্বরীর প্রতিমা নির্মাণ করতে হবে৷ ঐতিহ্যবাহী এই পুজোয় মিশে রয়েছে ইতিহাস। কীভাবে মা চাঁদুনি হলেন, রয়েছে তার নেপথ্যে একটি কাহিনী।
কাশীনাথ সার্বভৌম এবং গোপীনাথ সার্বভৌম নামে দুই ব্রাহ্মণ ছিলেন। শান্তিপুরের কাশীনাথ মুখোপাধ্যায় ও ভাই গোপীনাথ মুখোপাধ্যায় তন্ত্রসাধনা করতেন। কাশীনাথ ও গোপীনাথ পরবর্তীতে পান্ডিত্য অর্জন করে সার্বভৌম উপাধি পান। এমনও কথিত আছে, মাতৃসাধক কৃষ্ণানন্দ ও আগমবাগীশের বংশধর তান্ত্রিক যোগী কাছিমা ভট্টাচার্য গঙ্গায় ডুব দিয়ে কুম্ভক যোগে মায়ের আরাধনা শুরু করেন। আবার কেউ বলেন, কাশীনাথ সার্বভৌম এই পুজো শুরু করেন, শৈশবে কাশীনাথ নিজের মায়ের কাছে আবদার করে মাটি দিয়ে কালীমূর্তি তৈরী করান এবং কাশীনাথ সেই মূর্তি পুজো করেন। এখনও সেই প্রথা মেনে চলে ওই বাড়ির কালীপুজো। কাশীনাথ ছিলেন বিবাহিত। তার স্ত্রী ও অত্যন্ত কর্মনিষ্ঠ। একদিন কাশীনাথ বাড়িতে নিত্য পুজোয় বসেছেন। এমন সময় তার কাছে আসে একটি মেয়ে। মেয়েটি তার কাছে এসে বলে তার খিদে পেয়েছে, তাকে প্রসাদ দিতে। তখন কাশীনাথ বলেন পুজো সম্পন্ন হয়নি। সে প্রসাদ এখন দিতে পারবে না, পুজো সম্পন্ন হওয়ার পর সে প্রসাদ দিতে পারবে। নাছোড়বান্দা মেয়েটি বলে, আমার খুব খিদে পেয়েছে আমাকে এখনই প্রসাদ দিতে হবে। কিন্তু কাশীনাথ তাকে প্রসাদ না দিয়ে চলে যেতে বলেন সেই স্থান থেকে। মেয়েটি তখন চলে যায়। পুজো দেওয়ার পর কাশীনাথ সার্বভৌম যখন বাইরে প্রসাদ নিয়ে যায় তখন দেখেন মেয়েটি আর নেই। তখন সে ক্ষুধার্ত মেয়েটিকে খুঁজতে লাগে।
ওইদিন রাতে ঘুমানোর পর তার স্ত্রী স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে সেই মেয়েটি এসে তাকে বলে প্রসাদ চাওয়া সত্ত্বেও তার স্বামী তাকে প্রসাদ দেয়নি। এবং তিনি তার স্বরূপ দেখালেন কাশীনাথের স্ত্রীকে। এবং বলেন, "তোদের যে এই অপরাধ সেই অপরাধে গেলে আমার মূর্তির মতন মূর্তি বানিয়ে পুজো কর।" তার স্ত্রী স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী মূর্তি বানালেন। সেদিন ছিল পূর্ণিমা, তাই মায়ের নাম রাখলেন মা চাঁদুনি। তারপর অমাবস্যায় যথারীতি মা চাঁদুনির পুজো সম্পন্ন হয়। তার স্ত্রী এই প্রতিমাটি গড়েছিলেন বলে আজও মা চাঁদুনির প্রথম মাটি এই চাঁদুনি বাড়ির বড় মেয়ে মৃৎশিল্পীকে দিলে তবেই মৃৎশিল্পীরা করতে পারবেন মা চাঁদুনির প্রতিমা আরও এক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। প্রায় একই কাহিনী। সেই কিংবদন্তি অনুযায়ী, আজ থেকে প্রায় ২২ পুরুষ আগে এই পরিবারের আদিপুরুষ গোপীনাথ সার্বভৌম একদিন বাড়ির নারায়ণ শিলা পুজোয় আয়োজনে ব্যস্ত। কেউ কেউ বলেন বাগানে ফুল তোলার সময় মেয়েটি এসেছিল। এমন সময় একটি ছোট মেয়ে আসে। বাকি কাহিনীটা একই। আদপে মেয়েটি আর কেউ নন, স্বয়ং দেবী কালী। গোপীনাথ তাঁর কাছেই স্বপ্নাদেশ পান বাড়ির কাছেই পঞ্চমুণ্ডির আসনে 'মা চাঁদুনী' নামে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করে কার্তিক অমাবস্যার রাতে পুজো করতে হবে।
পরদিন গোপীনাথ তাঁর মাকে স্বপ্নের কথা জানিয়ে সেই মূর্তি তৈরি করে দেওয়ার মরার আবদার করেন। তাঁর মা ধীরে ধীরে সেই মূর্তি নির্মাণ করেন। বাড়ির কাছে বেল গাছের নীচে পঞ্চমুণ্ডির আসনে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে তন্ত্রমতে পুজো শুরু করেন গোপীনাথ। পরবর্তীকালে এই গোপীনাথ হয়ে ওঠেন পণ্ডিত এবং তন্ত্রসাধক। গোপীনাথের ভাই কাশীনাথ সার্বভৌম ছিলেন শ্রীচৈতন্যের গৃহশিক্ষক। পরবর্তীকালে শ্রীচৈতন্য সন্ন্যাস গ্রহণের পরে শান্তিপুরে কাশীনাথের সঙ্গে দেখা করতেও এসেছিলেন।
আজও রীতি মেনে এখানে পুজো হয়। বিজয়া দশমীর দিন বাড়ির বড় বউ দেবীর গায়ে মাটি দিয়ে মূর্তি নির্মাণের কাজ শুরু করেন। শান্তিপুরের মুখোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা যেখানেই থাকুন না কেন, পুজোর সময় সবাই চলে আসেন। দেবীর নামেই শান্তিপুরের মুখোপাধ্যায় পরিবারের বাড়িটির নাম 'চাঁদুনীবাড়ি' আর পাড়ার নাম 'চাঁদুনীপাড়া'। প্রথা মেনে কালীপুজোর দিন সকালে সোনার গয়না পরানোর পরে বাড়ির ছেলেদের কাঁধে চড়ে দেবী, দুর্গাদালান থেকে পঞ্চমুণ্ডির আসনে যান। যা পাটে ওঠা নামে পরিচিত।
শোনা যায়, একবার দেবীর স্বপ্নাদেশ হয়েছিল, পাটে ওঠার সময় রোদের মধ্যে দেবীর খুব গরম লাগে, তেষ্টা পায়। সঙ্গে সঙ্গে রুপোর ছাতা, রুপোর পাখার ব্যবস্থা করা হয়। মন্দিরে প্রবেশের আগে দেবীকে শীতলভোগ দেওয়ার রীতি রয়েছে। শীতলভোগে ভিজে মুগডাল, ডাবের জল, বেলের পানা, তরমুজ, শসা, ঠান্ডা দই-মিষ্টি ইত্যাদি দেওয়া। এখনও একাদশী তিথিতে সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে বসে নহবত বসে। প্রত্যেক দিন ৮ প্রহর নহবত বাজানো হয়। পুজোর আগের দিন সন্ধ্যাবেলা দেবীকে ডাকের সাজে সাজানো হয়। বাড়ির ছেলেরা পাটের চুলে জবাকুসুম তেল মাখিয়ে দেবীর কেশসজ্জা সারেন।চাঁদুনি মাকে দুটি মালা পরানো হয়, একটি লাল এবং একটি বেল গোলাপের। সোনার কামরাঙার মটরমালা থেকে শুরু করে সোনার শাঁখা বাঁধানো, নোয়া বাঁধানো, রতনচুড়, হাতপদ্ম, কোমরবন্ধনী, বাজুবন্ধ, পুষ্পহার, সীতাহার ইত্যাদি স্বর্ণালংকার এবং রৌপ্যালংকারে মাকে সাজানো হয়। দেবীর বুকে থাকে সোনার প্রজাপতি।
কালীপুজোর দিন পাটে ওঠার পরেই শুরু হয় চণ্ডীপাঠ। বাড়ির দীক্ষিত স্ত্রীয়েরা ভোগ রান্না শুরু করেন। ভোগের ঘরেই করা হয় দেবীর বিশ্রামের ব্যবস্থা। সেখানে দেওয়া হয় রঙিন শাড়ি, নরম বিছানা, তালপাতার পাখা, দাঁত খোঁচানো কাঠি। সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর পর রাত ১২টায় পঞ্চমুণ্ডির আসনে দেবীর পুজো শুরু হয়। এই পুজো করেন বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ দীক্ষিত পুরুষ। পুজো হয় পারিবারিক পুঁথি মেনে। পুজোয় আজও পশুবলি হয়। যজ্ঞ ও ঘট বিসর্জন হয়।
এই পুজোর দেখার মতো জিনিস হল নৈবেদ্য সাজানো। চাঁদুনী মাকে দুর্গাদালান থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় ক্ষীরের মিষ্টি খাওয়ানো হয়। মাথায় রুপোর ছাতা ধরে তাঁকে মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার পর পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসানো হয়। চন্ডিপাঠ শুরু হয়, তারপর খাঁড়া-সরা পুজো করা হয়। নিশিরাতের মায়ের আরাধনা করেন। চাঁদুনি মাকে নিরামিষ ভোগ প্রদান করা হয়। ভোগে থাকে আট রকমের ভাজা, পোলাও, খিচুড়ি, সাদা ভাত, চাটনি, পায়েস, মিষ্টি ইত্যাদি। গজা, পাকান্ন তৈরি হয়। মায়ের গোটা ফলের নৈবেদ্য হয় ও বারোমাস জন্য নানারকমের ফল, শাকসব্জি নিবেদন করা হয়। নানা ধরনের মিষ্টিও দেবীকে দেওয়া হয়। ভোগের ক্ষেত্রেও থাকে নানা ব্যাঞ্জন। গজা আর পক্কান্ন হল পুজোর প্রধান প্রসাদ। পুজোর পরদিন দুপুর ১২টায় বাজনা বাজিয়ে দালান থেকে প্রসাদী জিনিস তুলে ফেলা হয়। একে বলে ভাঙা বাসর। সন্ধ্যে ৬টায় দেবীকে বরণ করেন বাড়ির বউরা। রাত ৯টা নাগাদ আলোকসজ্জাসহ প্রতিমা নিরঞ্জনে নিয়ে যাওয়া হয়। আজও বাহকের কাঁধে দেবী যান। এই সময়ে মাঝ পথে একটি পরিবার থেকে দেবীকে মিষ্টি ও জল নিবেদন করা হয়। ঘাটে পৌঁছনোর বেশ কিছুটা আগে বাজনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ বিসর্জনের জন্য শোক পালন করা হয়। প্রতিমা নিরঞ্জনের পরে কাঠামোটি আবার বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়। যেহেতু দুর্গা বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে কালীর আবাহন শুরু হয় তাই এই বাড়িতে বিজয়া দশমী উৎসব পালন করা হয় না। কালীপুজোর পরের দিন বিজয়া হয়।
মায়ের নামে নিয়ে অনেক মত পার্থক্য রয়েছে। অনেকের মতে ‘চাঁদুনি’ নামটি এসেছে চাঁদনি থেকে, যার অর্থ জ্যোৎস্না। দুর্গাপুজোর শেষে দুর্গা দেউলেই শুরু হয় মায়ের কাঠামো গড়া। প্রতি অমাবস্যায় এখানে মাকে শক্তিরূপে পুজো করা হয়। কালী পুজোর দিন মা চাঁদুনিকে দুর্গা দেউল থেকে বাতাস করতে করতে কালীমন্দিরে আনা হয়। একসময় এখানে মোষ বলি হত। তা বন্ধ হয়ে এখন হয় পাঁঠাবলি। শাক্ত ও বৈষ্ণবের মিলনক্ষেত্র শান্তিপুর। মতিগঞ্জ মোড় এবং বড়বাজার বাসস্ট্যান্ডের মধ্যবর্তী স্থানে রাস্তার ধারে বামদিকে চাঁদুনী মায়ের মন্দির অবস্থিত। মন্দিরের ফলক থেকে জানা যায় মন্দিরটি ৮৯২ বঙ্গাব্দ স্থাপিত। সে সময় মন্দিরটি গঙ্গা তীরবর্তী অঞ্চলে থাকলেও সময়ের সঙ্গে গঙ্গা অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছে। মন্দিরের উল্টোদিকে এখন বর্ষাকালে সেই পরিত্যক্ত নদীখাতে জল উপচে ওঠে।
মুখোপাধ্যায় পরিবারের কালীপুজো হয় তাঁদের নিজেদের করা আলাদা পুঁথির মাধ্যমে যা গোপীনাথের লেখা। পারিবারিক প্রথা মেনে পরিবারের বড় বউ কাঠামোতে প্রথম মাটি দিয়ে মূর্তি গড়া শুরু করেন। বিজয়া দশমীর দিন শুরু হয় মূর্তি গড়ার কাজ, কালীপুজোর আগের দিন তা শেষ হয়। আজও রীতি মেনেই মায়ের পুজো হয় এখানে।