বউবাজারের জগদ্ধাত্রী মন্দির

চলছে হেমন্তকাল। হেমন্ত মানেই মা হৈমন্তীকার আরাধনার সময়। তিনি জগদ্ধাত্রী, দেবী দুর্গারই আরেক রূপ, উমা হৈমবতী। বঙ্গে নদিয়ার কৃষ্ণনগর ও হুগলির চন্দননগর, গুপ্তিপাড়ার জগদ্ধাত্রী উৎসব জগদ্বিখ্যাত। কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজো হয়। রাজসিক দেবী দুর্গা ও তামসিক কালীর পরেই দেবী জগদ্ধাত্রীর আরাধনার সময়। উত্তর কলকাতার বাগবাজার, শ্যামবাজার, পোস্তা, কুমোরটুলিতেই জাঁকজমক সহকারে জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। তবে খাস কলকাতার বুকেই জগদ্ধাত্রীর নিত্য আরাধনা চলে, রয়েছে মায়ের মন্দিরও। বউবাজার অঞ্চলের ১০৫/২, সার্পেন্টাইন লেনে রয়েছে জগদ্ধাত্রী মন্দির। স্থানীয় বাসিন্দারা এই মন্দিরকে ঠাকুরবাড়ি বলেন। ১৮৮৮ সালে অর্থাৎ বাংলার ১২৯৪ সনের ১২ মাঘ, পূর্ণিমার দিন এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কেদারনাথ দাস। মন্দিরের বাইরের দরজার উপরের দিকে প্রতিষ্ঠাফলকে সেই বিবরণ রয়েছে। দরজার বাম দিকের দেওয়ালে একটি ধাতুর ফলকও রয়েছে।

মন্দিরটি পশ্চিমমুখী। তিন খিলানযুক্ত এই মন্দির উঁচু বেদির উপর অবস্থিত। ছাদ সমতল। মন্দি দালান রীতিতে নির্মিত। গোলাকার স্তম্ভে দাঁড়িয়ে রয়েছে বারান্দা। মন্দিরের সামনে রয়েছে প্রাঙ্গণ। তাকে ঘিরে রয়েছে ঘর। মন্দিরের গর্ভগৃহে অবস্থান করেন সিংহবাহিনী দেবী জগদ্ধাত্রী। দেবী মূর্তি অষ্টধাতু নির্মিত। দেবী নিত্য পুজো হয়। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের উলটোদিকে কবি নবীন সেন লেন বা গোমেস লেন ধরে একটু এগোলেই সার্পেন্টাইন লেন, সেখানেই রয়েছে মন্দির। স্থানীয় বাসিন্দাদের বিশ্বাস দেবী অত্যন্ত জাগ্রত। তাই বিপদে-আপদে শতাব্দীপ্রাচীন মন্দিরে গিয়েই দেবীর শরণাপন্ন হন অনেকেই, বিপদ থেকে উদ্ধারও পান।

আবার বউবাজার এলাকায় মুচিপাড়া থানার ১০ নম্বর বাবুরাম শীল লেনের নৃত্য ভবনে অর্থাৎ দত্ত বাড়িতে চলে জগদ্ধাত্রীর আরাধনা। দত্ত পরিবার পাঁচ পুরুষ ধরে জগজ্জননী জগদ্ধাত্রীর আরাধনা করে আসছেন। জানা যায়, দত্ত পরিবারে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূত্রপাত করেন পরিবারের আদি পুরুষ বলাই চাঁদ দত্ত। প্রথম কয়েক বছর ১৩ নম্বর বাবুরাম শীল লেনের বাড়িতে পুজো হয়েছিল। বলাইচাঁদ দত্তের পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র নৃত্যলাল দত্ত জগদ্ধাত্রী পুজোর শুরু করেন। তিনি ১০ নম্বর বাবুরাম শীল লেনে তিন খিলানের ঠাকুরদালানসহ বিশাল অট্টালিকা তৈরি করেন, সেখানেই পুজো স্থানান্তরিত করেন। এখানে দেবী মূর্তি ডাকের সাজে সজ্জিতা, স্বর্ণালংকারে ভূষিতা নয়নাভিরাম। মায়ের রূপ শান্ত স্নিগ্ধ প্রসন্নময়ী। দেবী জগদ্ধাত্রী চতুর্ভুজা, তাঁর চার হাতে থাকে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম। দেবীর বাহন শ্বেতবর্ণের সিংহ। সিংহের পদতলে হস্তিমুণ্ড। দেবীর দুই পাশে দুই সহচরী—জয়া ও বিজয়া। জগদ্ধাত্রী পুজোর আগের দিন সন্ধ্যায় দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাস। পুজোর দিন সকালে ৭ নম্বর বাবুরাম শীল লেনস্থ ঠাকুরবাড়ি থেকে নারায়ণ, মা মঙ্গল চণ্ডী, মা লক্ষ্মীকে নৃত্য ভবনে নিয়ে আসা হয়। প্রাণ প্রতিষ্ঠা ও চক্ষুদান করে পুজোর সূচনা হয়।

সন্ধিপুজোর সময়ে মহিলারা দুই হাতে সরা এবং মাথায় একটা মালসা নিয়ে সারিবদ্ধভাবে বসে কাঠ-কয়লার আগুনে পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে ধুনো পোড়ান, সুবর্ণ বণিক সম্প্রদায়ের নিজস্ব রীতি এটি। বৈষ্ণব মতে পুজো হয় বলে বলির প্রথা নেই। অন্নভোগ হয় না। দশমী পুজো আর দর্পণে মায়ের চরণ দর্শনের পালা চলে। বিদায় মুহূর্তে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য মা জগদ্ধাত্রীর পা ধুইয়ে দেন এবং মাকে কানে কানে আগামী বছর আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। শেষে কনকাঞ্জলি দিয়ে মা জগদ্ধাত্রীকে বিদায় জানানো হয়। প্রথা মেনে বাবুঘাটে জগদ্ধাত্রী প্রতিমা নিরঞ্জন হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...