ঘুম থেকে সকালে উঠলেন আর খেয়াল করলেন গলার স্বরটা বেশ ভেঙেছে। অসময়ের বৃষ্টির জন্য বা হঠাৎ ঋতু পরিবর্তনের কারণে সর্দিকাশি প্রায় প্রতি বাড়ির ঘটনা। ঠান্ডা লেগে গলা বসে যাওয়াও এখন আর নতুন কিছু নয়। কিন্তু অনেকক্ষেত্রে আবার কারণ বোঝা যায় না। মনে করা হয় হয়তো কোনোভাবে ঠান্ডা লেগে গেছে। অমনি নানা ঘরোয়া টোটকার ব্যবহার চলতে থাকে। তুলসী মধু খাওয়ানো থেকে শুরু করে নুন জলে গার্গল করা, চলতে থাকে সবই। কিন্তু কোনসময় চিকিৎসকের কাছে যাওয়া প্রয়োজন তা জানা একান্ত আবশ্যক। অনেকক্ষেত্রে গলা বসে যাওয়া কোনো কঠিন রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে। তাই সময় থাকতে থাকতে জেনে নিন কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক, কোন কোন কারণে গলা বসতে পারে-
১) ঠান্ডা লেগে গলা বসা বা স্বর ভেঙে যাওয়ার সমস্যা অনেককেই ফেস করতে দেখা যায়। ঠান্ডা লেগে গলা ফুলে গেলে, ভোকাল কর্ড যেই বস্তুটি আমাদের স্বর সৃষ্টি করতে প্রভূত সাহায্য করে, সেই ভোকাল কর্ডে ইনফ্লেমেশন সৃষ্টি করে থাকে। এর ফলে ভোকাল কর্ডের ভাইব্রেশনেও সমস্যা সৃষ্টি হয় এবং এর ফলেই গলার স্বর ভেঙে যায়।
২) স্বরের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলেও গলা ভাঙতে পারে। হয়তো আপনাকে সকাল থেকে খুব বেশি কথা বলতে হয়েছে কিংবা এমন কোনো কাজ করতে হয়েছে যার ফলে ভোকাল কর্ডের উপর চাপ পড়েছে সেই ক্ষেত্রে আপনার গলা ভাঙতে পারে। স্বরের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে গলায় মাসল স্ট্রেন হতে পারে। এর ফলে গলা বসে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত কাশির থেকেও গলা ভাঙার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৩) ধূমপানের নানা ক্ষতিকর প্রভাবের মধ্যে গলার সমস্যা অন্যতম। সিগারেটের ধোঁয়া ভোকাল কর্ডকে ডিস্টার্ব করে। ধূমপানের ফলে দীর্ঘকালীন গলার স্বরের সমস্যাও হতে পারে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব ব্যক্তি ধূমপান করেন তাদের গলার সমস্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশিমাত্রায় রয়েছে যারা ধূমপান করেন না তাদের তুলনায়। ধূমপানের ফলে ভোকাল কর্ডে অনেকসময় নন ক্যান্সারাস গ্রোথ বা পলিপ দেখা যায়। পলিপ বড় হওয়ার সাথে সাথে গলার স্বর কমতে থাকে।
৪) অ্যালাৰ্জি থেকেও অনেকসময় গলা বসার সমস্যা দেখা যায়। অ্যালাৰ্জির কথা বললে নাক দিয়ে গড়গড়িয়ে জল পড়া আর চোখ চুলকানোর কথা মনে পড়লেও, দেখা যায় এইগুলি ছাড়াও আরও নানা সমস্যা অ্যালাৰ্জির ফলে সৃষ্টি হয়েছে। অনেকসময় কাশির কারণে ভোকাল কর্ড ফুলে যাওয়ার সমস্যা তৈরী হয়। এছাড়াও পোস্টন্যাসাল ড্রিপ থেকেও গলা খুসখুস করতে পারে।
এইগুলি হলো কিছু আপাত কারণ। এর পরে আসে সেইসব কারণ যা ট্রিটমেন্টের অভাবে মারাত্মক আকার নিতে পারে। সেইসব রোগগুলি হলো-
১) রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস- এটি একধরণের অটোইমিউনো ডিজিজ। এর ফলে শরীরের নানা জয়েন্ট-এ ব্যাথা অনুভব হয়ে থাকে। এই রোগে আক্রন্ত প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের ভোকাল সমস্যা হয়ে থাকে। এর থেকে গলা ফুলে যাওয়া এবং গলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সমস্যাও দেখা যায়।
২) থাইরয়েডের সমস্যা- থাইরয়েড থেকে যথাক্রমে টি ১, টি ২, টি ৩ এবং টি ৪ এই চারধরণের হরমোনের নিঃসরণ হয়ে থাকে। থাইরয়েড থেকে নিঃসৃত হরমোন শরীরের নানা কাজকর্মের খেয়াল রাখে। তাই থাইরয়েড হরমোন পর্যাপ্ত পরিমান ক্ষরিত না হলে ভয়েসে পরিবর্তন আসতে পারে।
৩) জিইআরডি- এই রোগের ক্ষেত্রে পাকস্থলী থেকে অ্যাসিড উপরের দিকে উঠে আসতে থাকে। অ্যাসিডের রিফ্লাক্স হওয়ার ফলে তা গলায় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এই রোগের থেকে হার্টবার্ন-এর সমস্যার সাথে সাথে ভয়েস লসও হতে পারে। এছাড়াও পাকস্থলী থেকে উঠে আসা অ্যাসিড ভোকাল কর্ডে ইনফ্লেমেশন সৃষ্টি করতে পারে।
৪) ল্যারিঞ্জাইটিস- এটি নিজে কোনো রোগ নয়। কিন্তু অনেক বড় রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে এটি। এই রোগটির অর্থ হলো ভয়েস সম্পূর্ণভাবে চলে যাওয়া। ঠান্ডা লাগার ফলে কিংবা অতিরিক্ত স্বরের ব্যবহারের ফলে হঠাৎ স্বর চলে যাওয়ার ঘটনাকে ‘অ্যাকিউট ল্যারিঞ্জাইটিস’ বলা হয়। এটি ছাড়াও ‘লং টার্ম ল্যারিঞ্জাইটিস’ও হতে পারে। নিঃশ্বাসের সময় কোনোভাবে রাসায়নিক ধোঁয়া গলায় প্রবেশ করলে তা ভোকাল কর্ডে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে আবার শ্বাসনালিতে ইস্ট ইনফেকশনও হতে পারে। যাঁরা অ্যাজমায় ভুগছেন তাঁদের নিয়ম করে ইনহেলার নিতে হয়। ইনহেলারের মধ্যে থাকা ওষুধে উপস্থিত থাকে স্টেরয়েড। তাই দীর্ঘদিন ইনহেলার ব্যবহার করতে থাকলে গলা বসার সমস্যা তৈরী হতে পারে।
৫) স্নায়ুতন্ত্রের রোগ- পার্কিনসন ডিজিজের মতো রোগে মুখমন্ডল ও গলার মাসল ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, পার্কিনসন ডিজিজে ভোগা রোগীদের মধ্যে ৯০ শতাংশ ব্যক্তি ভয়েস ডিসঅর্ডারের শিকার হয়েছেন। পার্কিনসন ডিজিজে ব্রেনের যেই অংশ দেহের মুভমেন্টে সাহায্য করে তাকে বসিয়ে দেয়। ফলে কথা বলার সময় যেসব মাসলের মুভমেন্টের প্রয়োজন হয় সেইগুলি তাদের কর্মক্ষমতা হারায়।
৬) ল্যারিঞ্জিয়াল ক্যান্সার- ল্যারিঞ্জিয়াল ক্যান্সারের অর্থ গলার ক্যান্সার। দীর্ঘকালীন ভয়েস লস প্রত্যক্ষ করলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত কারণ দীর্ঘদিন ধরে ভয়েসের সমস্যা হওয়া ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে। গলা বসে যাওয়াও সাথে সাথে খাবার গেলার সময় সমস্যা, কানে ব্যথা, নিঃশ্বাসে কষ্ট হওয়া প্রভৃতি যদি প্রত্যক্ষ করেন তাহলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সামান্য ঠান্ডা লাগা থেকে গলা যেমন বসতে পারে সেরকম কঠিন রোগের পূর্বাভাস হিসেবেও গলা বসতে পারে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, দুই সপ্তাহের বেশি সময় যদি গলা বসে থাকে তাহলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিৎ।