পাঞ্জাবের অমৃতসর থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার পেরোলেই মিলবে তারন-তারান। সেখান থেকে আটারি রোড ধরে এগোলেই মিলবে ‘সরাই আমানত খান’। যার ভগ্নপ্রায় স্থাপত্যের সাথে জড়িয়ে আছে মুঘল ইতিহাস। আর সেই ইতিহাস খোদ তাজমহলের সাথে সংযুক্ত। আজ জানাবো সেই তথ্য।
কিন্তু এই ‘সরাই আমানত খান’ এর বিশেষত্ব কি! প্রথমেই জানিয়ে রাখি এটি একটি সরাইখানা। আর যার নামে এই সরাইখানা, তার সাথেই জড়িত সেই ইতিহাস। এবার আসি ‘আমানত খান সিরাজি’র সম্পর্কে। এই আমানত খান সিরাজি ছিলেন মুঘল আমলের শ্রেষ্ঠ অক্ষর শিল্পী বা ক্যালিগ্রাফার। তাজমহল গাত্রে যে কোরানের ক্যালিগ্রাফি দেখা যায়, তা তাঁরই সৃষ্টি। যদিও ঐতিহাসিকদের মতে, আমানত খানের জন্মভিটে ছিল ইরান এবং তাঁর প্রকৃত নাম ছিল আবদ-অল হক। কিন্তু এই নামের অন্তর্ধানের পিছনে আছে আর এক ইতিহাস।
আবদ-অল-হক ছোটো থেকেই ক্যালিগ্রাফিতে ছিলেন দক্ষ, তাঁর হাতে প্রাণ পেতো অক্ষর। আর তাঁর এই গুনের কদর করতে দ্বিধা করেননি তার দাদা আফজল খান। শাহজাহানের শাসনকালে ভাইকে নিয়ে তিনি চলে আসেন ভারতে মুঘল রাজদরবারে।
আফজল খান নিজ দক্ষতায় মুঘল রাজদরবারের অন্যতম প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন। কিন্তু আবদ-অল-হকের ক্যালিগ্রাফিতে মুগ্ধ শাহজাহান একের পর কাজের দায়িত্ব দেন তাকে। সিকান্দ্রায় সম্রাট আকবরের সৌধের বাইরের বড়ো গেটওয়েতে কোরানের ক্যালিগ্রাফি ছিল তাঁরই সৃষ্টি। ইতিমধ্যেই বেগম মুমতাজের মৃত্যুতে ব্যথিত হয়ে বেগমের স্মৃতিকে অমরত্ব দিতে আগ্রায় শ্বেত পাথরের তাজমহল নিৰ্মানের সিদ্ধান্ত নেন শাহজাহান। নির্মাণের পর ভেতরের দেওয়ালকে আকর্ষণীয় করতে দায়িত্ব দেন সেই আবদ-অল-হককে। ১৬৩২ থেকে ১৬৩৮ - দীর্ঘ ছয় বছর ধরে তাজমহল গাত্রে কোরানের বাণী নিজের ক্যালিগ্রাফির সৌন্দর্য্যে ভরিয়ে দিলেন। শাহজাহান প্রীত হয়ে তাঁকে ‘আমানত খান’ নাম দেন এবং মনসব পদে উন্নীত করেন। জন্ম হলো আবদ-অল-হকের আড়ালে আমানত খানের। বিস্মৃত হলো আবদ-অল-হক।
সম্মান প্রাপ্তি হলো বটে, কিন্তু হারালেন জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়কে। মারা গেলেন তাঁর দাদা আফজল খান আর সেই সাথে আমানতখানও চলে গেলেন লাহোর। আর আগ্রায় ফেরেন নি, তবে নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন মানুষের কাজে। উপার্জিত সমস্ত অর্থ নিয়োগ করেন জন কল্যানে।
আজ যে সরাইখানার কথা দিয়ে শুরু করলাম তার পাশে ছিল ওল্ড গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড তৎকালীন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি রাস্তা। লাহোর শহরের বাইরে সেই রাস্তারই পাশে তৈরি করলেন এই সরাইখানা-নাম দিলেন ‘সরাই আমানত খান। দুদিকে দিল্লি গেট এবং লাহোরি গেট- দুই প্রবেশ পথ, সেই সঙ্গে সরাইখানার ভেতরের বাড়ি ও স্থাপত্যগুলি ভরিয়ে দিলেন ক্যালিগ্রাফিতে।
এই সরাইখানায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। পরবর্তীকালে দেশভাগ হয়েছে কিন্তু ‘সরাই আমানত খানের’ মূল অংশটি ভারতের পাঞ্জাবের মধ্যে থাকলেও তা আজ ভগ্নস্তূপ। গোটা সরাইখানা জুড়ে যে ক্যালিগ্রাফি এঁকেছিলেন আমানত খান, তার সামান্যই পরিলক্ষিত হয় দেওয়ালে। কিছু সংরক্ষিত আছে মিউজিয়ামে। কিন্তু এই বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফারের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার কোনো তাগিদ সেই অর্থে প্রশাসনের তরফ থেকে দেখা যায়নি। তবে এক্কেবারে বিলীন হওয়ার আগে উদ্যোগ নিলে ভালো, না হলে এই ইতিহাস গহ্বরে তলিয়ে যাবে। তবে যতদিন তাজমহলের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন আমানত খান থাকবেন জীবিত।