হিপ্নোটিজম জাদুবিদ্যার অংশ একথা সবারই জানা। আবার চিকিৎসা শাস্ত্রে, বিশেষত মনস্তত্বে এখন তার ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই বিষয়কে চিকিৎসার অন্তর্ভুক্তির ধারণা আজকের ঘটনা নয়। সর্বাগ্রে এই সম্মোহন বা হিপ্নোটিজম ব্যবহার করা হয় শল্য চিকিৎসার কাজে। অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। সম্মোহনকে যে মূলত শল্য চিকিৎসায় প্রয়োগ করা যেতে পারে তা ছিল কল্পনাতীত। আর যে সময়ে এই সম্মোহন বিদ্যা কার্যকরী হয় তখন ক্লোরোফার্ম আবিষ্কার হয় নি, তাই রোগীর যন্ত্রনা মুক্তির এই প্রক্রিয়া বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর সেই উদ্দেশ্যেই কলকাতায় এমন সম্মোহন চিকিৎসার হাসপাতাল তৈরী হয়। কিন্তু কোথায়? কে-ই বা এর সূচনা করেন সেই তথ্যই দেব।
সময়টা ১৮৪৫ সালের এপ্রিল মাস। ঘটনার সূত্রপাত হুগলির ইমামবাড়া হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের উদ্দেশ্যে আসা এক কয়েদিকে কেন্দ্র করে। তখনও অ্যানাসথেসিয়ার ব্যবহার শুরু হয়নি। আর এখানেই ডাঃ জেমস ইসডেল একটি অদ্ভুত উপায় বের করলেন যাতে প্রায় দেড় ঘন্টার মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে গেল কয়েদি আর সে এমন ঘুম যা কোনো কিছুতেই ভাঙলো না। এরই ফাঁকে ডাক্তাররাও সেরে ফেললেন অস্ত্রোপচার। না, একফোঁটাও চিৎকার করল না রোগী। ডাক্তাররাও বুঝে উঠতে পারলেন না। কিন্তু কি এমন করলেন ইসডেল !!! করলেন সম্মোহন। এদিকে জ্ঞান ফিরলে, কয়েদিও অবাক! যদিও তার আগে এর বহুল ব্যবহার করে দেখেছিলেন ডাঃ জেমস ইসডেল। ১৮৪৫-এর এপ্রিল থেকে ১৮৪৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সম্মোহনের সাহায্যেই ৩৭টি অপারেশন করেছিলেন তিনি। রোগী বিন্দুমাত্রও টের পায়নি। সেই শুরু শল্য চিকিৎসায় সম্মোহনের ব্যবহার।
এক্কেবারে নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি। আর তার জনপ্রিয়তার কারণেই প্রথমে ক্যালকাটা নেটিভ হাসপাতালের একটি ঘরে পৃথকভাবে শুরু হয় সম্মোহন হাসপাতালের কাজ। প্রথম দশজন রোগীর মধ্যে সাত জনকে সম্পূর্ণ সুস্থ করা হয় এখানে। এমনকি, জটিল টিউমার অপারেশনও করা হয়। পরে এখানকার কাজের অগ্রগতি দেখে ১৮৪৬ সালে কলকাতার মট লেনে সম্পূর্ণ পৃথক একটি হাসপাতাল খোলার অনুমতি দেয় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। নাম হয় ‘ক্যালকাটা মেসমেরিক হাসপাতাল’। হাসপাতালের দায়িত্ব নেন ডাঃ জেমস ইসডেল।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই চিকিৎসা পদ্ধতি সর্বসাধারণের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কারণ প্রথম বেদনাহীন অস্ত্রোপচার। পদ্ধতি ওই একটিই, সম্মোহন! সম্মোহনের পর রীতিমতো সূচ ফুটিয়ে রোগীর জ্ঞান পরীক্ষা হত। নিশ্চিত করে তবেই আসল কাজ হত। তবে বেশ সময় লাগত এই সম্মোহনের কাজে। অনেক ক্ষেত্রে কয়েক দিনও লেগে যেত। শুধু অপারেশনই নয়, অন্যান্য চিকিৎসাও হত। তার জন্য ছিল আলাদা বিভাগ। কিন্তু এই কাজে বিপদের সম্ভাবনা কম ছিল না।
প্রাথমিকভাবে এক বছরের জন্য শুরু করা হয়েছিল এই হাসপাতাল। কিন্তু অপারেশন চলাকালীন বেশ কিছু রোগীর জ্ঞান ফিরে আসার ফলে সরকারের কাছে খারাপ রিপোর্ট যায়। ফলে, ১৮৪৮ সালের ৩রা জানুয়ারি ক্যালকাটা মেসমেরিক হাসপাতাল চিরতরের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
যদিও ব্যক্তিগত ভাবে সম্মোহন চিকিৎসা চালিয়ে গিয়েছিলেন ডাঃ ইসডেল। ১৮৫১ সালে তাঁর অবসরের সাথে ইতি হয় এই চিকিৎসা পদ্ধতির। ততদিনে ক্লোরোফর্মও চলে আসে এই দেশে। কিন্তু এইরকম অদ্ভুত চিকিৎসা পদ্ধতির ইতিহাস আজও রয়ে গেছে ভারতে। যার স্মৃতি বয়ে চলেছে হুগলির ইমামবাড়া হাসপাতাল এবং কলকাতা।