বাঙালির নস্টালজিয়া "মার্গো" সাবান

হাল আমলে বাঙালির গরমকাল আসে, চৈত্র-বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাস জুড়ে। আগে বাঙালির গরম আসত পয়লা বৈশাখের হালখাতা, পঁচিশে বৈশাখে রবি ঠাকুর, কালবৈশাখী আর আইসক্রিমের গাড়ির টিং টিং শব্দে ভর করে। বিগত বছরগুলিতে গরম বেড়েছে অনেক, সামনের বছরেও গ্রীষ্ম আসবে নিয়মমাফিক। গ্লোবাল ওয়ার্মিং আর দূষণের জোড়া ফলার দৌলতে গরমের দাপট চলবে। স্নান করার বহর বাড়বে বাঙালির। আর মনে পড়বে তার কথা, হ্যাঁ বোরোলিনের মতোই সেও বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। মার্গো সাবানের কথা মনে পড়ে? এখন বৈচিত্র্যপূর্ণ নিত্য নতুন রঙের, গন্ধের, আকারের সাবান, বডিওয়াশের যুগ। মার্গো সেখানে নিতান্তই সিনিয়ার সিটিজেন। কালের নিয়মে আমরা হয়ত তাকে রিটায়ারমেন্ট দিয়ে দিয়েছি।

Margo1

কিন্তু একসময় সত্যিই মার্গো সাবানের কোনও কম্পিটিটার ছিল না এই বঙ্গে। শুধু বাঙালি-বাংলারই নয়, এক সময় সারা ভারতেই রমরমিয়ে চলত মার্গো সাবানের রাজত্ব। গাঢ় সবুজ বর্ণের, নিমের গন্ধ যুক্ত সেই সাবানের কথা আমাদের অনেকেরই স্মৃতি জুড়ে বিরাজ করে। এতরকমের রঙিন সাবানের দিন তখনও আসেনি। এক সময় এ সাবান ছাড়া বাঙালির গ্রীষ্মকাল অসম্পূর্ন থেকে যেত।

 

কালের নিয়মে ব্যবহার কমেছে শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া এই সাবানের। কিন্তু মার্গো সাবান তৈরি হল কবে? আর কোথায়'ই বা ছিল তার জন্মস্থান? জন্মদাতাই বা কে? আর কেনই বা তৈরি হল দেশের সাবান?

 

রাসবিহারী পেরিয়ে ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের মোড় থেকে বাঁদিক বারাবার সোজা এগিয়ে গেলেই ৩৫ নম্বর পণ্ডিতিয়া রোড পড়বে।
আজ সেখানে বহুতল বাড়ি, বিলাশবহুল আধুনিক সমস্ত সু্যোগসুবিধাযুক্ত চোখ-ধাঁধানো আকাশঝাড়ু অ্যাপার্টমেন্ট আছে বটে! কিন্তু টাইমমেশিনে করে মাত্র বছর কুড়ি পিছিয়ে গেলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে ইতিহাসে। এক্কালে এখানেই ছিল বিখ্যাত ক্যালকাটা কেমিক্যাল কোম্পানি, ১৯১৬ সালে খগেনচন্দ্র দাশ যা তৈরি করে ছিলেন। খগেন বাবুর পদবি ছিল দাশগুপ্ত।

Margo2

কিন্তু তিনি নাম থেকে বাদ দিলেন গুপ্ত। কারণ নাম থেকে বৈদ্য-পরিচয় ঘোচাতে হবে। জাতপাতের বিরুদ্ধে এভাবেই প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সেসময়। কী আশ্চর্য! ভারত বদলায়নি এক চুলও। একশো বছরে আগেও এই ধারণাকেই ভাঙেনি, ভেঙে ছিল হিন্দুদের বর্ণপ্রথার রীতিকেও। সঙ্গে ছিল ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গি।

 

এই বদলের কান্ডারি ছিলেন খগেনচন্দ্রের মত মানুষেরা। তাঁর পিতা ছিলেন আদালতের বিচারক, রায়বাহাদুর উপাধির অধিকারী। ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর নিত্যদিন ওঠাবসা চলত। মা ছিলেন মোহিনী দেবী, তিনি আজীবন গান্ধীবাদী আদৰ্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তার উপর মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির মুখপাত্র। মায়ের প্রভাবই পড়েছিল খগেনচন্দ্রের জীবনে।

 

পড়াশোনার পাঠ শেষ করে শিবপুর কলেজে অধ্যাপনা করতে শুরু করেন খগেনচন্দ্র। সেখানেই তিনি জড়িয়ে পড়েন ব্রিটিশ বিরোধী বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। সেসময়ে ব্রিটিশ পুলিশের গ্রেপ্তারির হাত থেকে ছেলেকে বাঁচাতে তাঁর পিতা তাঁকে রাতারাতি বিলেতে পাঠিয়ে দেন। মার্কিনমুলুকে প্রথমে বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পরে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রের পড়াশোনা শেষ করেন খগেনচন্দ্র। এইসময় তাঁর সহপাঠী ছিলেন সুরেন্দ্রমোহন বসু। পরবর্তীকালে এই সুরেন্দ্রমোহন বসুই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিখ্যাত ডাকব্যাক। বিলেতে থাকতেই খগেনচন্দ্র লালা হরদয়ালের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের অন্যতম সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন।

Margo3

পড়াশোনা শেষ করে জাপান ঘুরে অবশেষে কলকাতা ফেরেন খগেনচন্দ্র। ৩৫ নম্বর পণ্ডিতিয়া রোডে তৈরি করেন ঐতিহ্যবাহী ক্যালকাটা কেমিক্যাল। সময়টা ছিল ১৯১৬, স্বদেশি আন্দোলনে তখন দেশ উত্তাল। আকাশে বাতাসে তখন বিলিতি দ্রব্য বর্জনের হাওয়া। কিন্তু দেশীয় জিনিসও তো চাই। এই সময়ই জন্ম হল নিমের পাতা দিয়ে তৈরি নিম সাবান অর্থাৎ মার্গো। সঙ্গে নিম টুথপেস্ট।

 

এছাড়া দেশের ভেষজ উপাদান ব্যবহার করে তৈরি হল মহাভৃঙ্গরাজ তেল, চেক ডিটারজেন্ট, ল্যাভেন্ডার ডিও পাউডার। সময়ের পেরিয়ে গেল আরও চারটে বছর, ১৯২০ সাল স্বদেশি আন্দোলনে সাড়া ফেলে দিল ক্যালকাটা কেমিক্যাল। বাড়ি বাড়ি পৌঁছে গেল মার্গো, ল্যাভেন্ডারের সুগন্ধি। বিলেতি জিনিসকে বাতিল করে নতুনভাবে দেশ গড়ার সময় তখন। সেই কাজেই হাত দিয়েছিলেন খগেনচন্দ্র দাশ এবং আরও অনেকে।

 

পণ্ডিতিয়ার পুরনো বাসিন্দারা হয়ত আজও মনে করতে পারেন, ঐ এলাকা জুড়ে মার্গোর গন্ধ। এদের মার্গোর সাবানই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় পণ্য। এই সাবানের বিজ্ঞাপনে লেখা হত - 'এই দারুণ গরমের দিনে - আরামে থাকা যায়, যদি প্রতিদিন স্নানে ও প্রসাধনে থাকে ক্যালকাটা কেমিকোর সুগন্ধি নিম টয়লেট সাবান মার্গো'। প্রকৃতি অর্থেই মার্গো সাবান ছিল বাঙালির সে যুগের এক অহঙ্কারের জিনিস।

Margo4

এরপরে অবশ্য কলকাতা এবং বাংলা সীমানা ছাড়িয়ে ক্যালকাটা কেমিক্যাল পাড়ি জমিয়েছিল তামিলনাড়ুতে। তারপরে এশিয়ার অন্যান্য নানান দেশেও ছড়িয়ে পড়ে বাঙালির অহঙ্কার মার্গো।

 

কিন্তু সুদিন তো আর চিরকাল স্থায়ী হয় না। ভাল সময় যায়, দুঃসময় আসে। খগেনচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর বংশধরেরা কারখানার হাল ধরেছিল। কিন্তু সময়ের নিয়মে যা হয়। শোনা যায়, ২০০১ সালে মার্গো সাবানের ব্র্যান্ডভ্যালু হয়েছিল ৭৫ কোটি টাকা।জার্মানির এক বিখ্যাত বহুজাতিক কোম্পানি হেঙ্কেল, কিনে নেয় এই ব্র্যান্ড।

 

আজও মার্গো সাবান তৈরি হয়। কিন্তু তাতে বাংলা তথা স্বদেশি যুগের কোনও চিহ্নই নেই। তবু আজও পণ্ডিতিয়া রোডে কিছু কিছু পুরনো ইমারত নিথর দাঁড়িয়ে বাংলার ঐতিহ্যবাহী ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...