ব্রিটিশ ভারতবর্ষের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি। তৎকালীন ওয়ালটেয়ার শহর। ওয়ালটেয়ার শহরকে চেনা যেত প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দিয়ে। ওয়ালটেয়ার শহরের সৌন্দর্য বরাবরই আকৃষ্ট করত এক কিশোরকে। ওই কিশোরটি ছিল পড়াশোনায় মেধাবী। তাঁর পরিবারেও চর্চা ছিল পড়াশোনার। তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লী শহরের খুব কাছে ছিল ছোট্ট একটি গ্রাম, নাম তিরুবনইক্কবল। এখানেই থাকত ওই কিশোর। ওয়ালটেয়ারের সমুদ্রের সৌন্দর্য কিশোরকে টেনে নিয়ে যেত তার কাছে। সমুদ্রের নীল জলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মনের একটা স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি দেখতে পেতে ওই কিশোর। "সমুদ্রের জল এত নীল কেন" নিজেকেই প্রশ্ন করত সে। কোনো গূঢ় রহস্য লুকিয়ে আছে সমুদ্রের জলে। সূর্যের আলো সেই জলে পড়ে যে চকমকি পাথরের মত আলোর জন্ম দিত, সেই আলোই ছিল তাঁর ইচ্ছের উৎস। দেশের সেবা করার জন্যে বিজ্ঞানকে বেছে নিয়েছিলেন সেদিনের সেই কিশোর। চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন। ১৮৮৮ সালের ৭ই নভেম্বর জন্ম এই বিজ্ঞানীর। বাবা চন্দ্রশেখর আইয়ার ছিলেন কলেজের অধ্যাপক। মা পার্বতী আম্মান। মায়ের পরিবারেও ছিল সংস্কৃত ভাষার চর্চা। সব মিলিয়ে পারিবারিক শিক্ষার আবহে বড় হন ভেঙ্কট রামন। বাড়িতে নানান জ্ঞানী গুণী মানুষের যাতায়াত ছিল। মুনি ঋষিদের জীবনবৃত্তান্ত তাঁকে শোনানো হত ছোটবেলা থেকেই। এই সমস্ত কাহিনী শুনে কিশোর বয়স থেকেই তার মনে দেশের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা জন্ম নেয়। দেশ সেবায় ব্রতী হওয়ার ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হন তিনি। গর্ব বোধ করতেন দেশের জন্য।
তাঁর বিজ্ঞান চর্চার রসদ অনেকটাই পাওয়া বাবার থেকে। ১৯০০ সালে তিনি বিশাখাপত্তনমের একটি হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন। ১৯০২ সালে ভর্তি হন মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজে-যেখানে অধ্যাপনা করতেন তাঁর বাবা। ১৯০৪ সালে স্বর্ণপদক সহকারে বি এ পরীক্ষায় পাশ করেন। এম এ পরীক্ষাতেও সর্বোচ্চ নম্বর সহকারে পাশ করেন এই মেধাবী যুবক। তাঁর ইচ্ছে ছিল আরো গবেষণার জন্য বিদেশ যাত্রা করা। তবে সেই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত সুফল দেশের উন্নতির জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন তিনি। বিদেশ যাত্রা সম্ভব না হলেও ১৮ বছর বয়সে বিশ্ব বিখ্যাত গবেষণাধর্মী পত্রিকা "ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে" তাঁর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। প্রথমবার এত কম বয়সে ভারতবর্ষের কোনো ছাত্রের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল ওই ম্যাগাজিনে। এরপরই তিনি ভারতের অর্থ দপ্তরে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারেন, তাঁর অন্তর জুড়ে রয়েছে গবেষণার ইচ্ছে। নতুন তথ্য আবিষ্কারের মাধ্যমেই জীবনের দিশা খুঁজে পেতেন তিনি। তাই কাজের ফাঁকে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন গবেষণা নিয়ে। "ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সায়েন্স" সংস্থার গবেষণাগারে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন।১৯১৭ সালে যোগ দিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি ব্যাঙ্গালোরের "ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স" -এর অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। দেশের ছাত্র ছাত্রীদের গবেষণার ক্ষেত্রে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ব্যাঙ্গালোরে স্থাপন করেছিলেন "রামন ইনস্টিটিউট অফ রিসার্চ সেন্টার" গবেষণা কেন্দ্রটি। ১৯২৬ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয় "ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ ফিজিক্স" পত্রিকা। তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোন প্রতিভা যাতে সুযোগের অভাবে বঞ্চিত না হয়, তার জন্যই নিজের জ্ঞানের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে দিতেন এই মহান বিজ্ঞানী।
১৯২২ সালে 'মলিকিউলার ডিফ্র্যাকশন অফ লাইট' নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করলেন। স্বচ্ছ কোনো বস্তুর উপর আলো পড়লে, সেই বিচ্ছুরিত আলোর কিছু অংশের তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন হয় - এই ছিল তাঁর গবেষণার মূল বিষয়বস্তু। এর নাম 'রমন এফেক্ট'। এই গবেষণায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর প্রিয় ছাত্র , কে এস কৃষ্ণন। আলোর বিচ্ছুরণএর উপর তিনি প্রথমবার আলোকপাত করেছিলেন। এই গবেষণার জন্যই তিনি ১৯৩০ সালে বিজ্ঞান বিভাগে ভারতবর্ষের তরফ থেকে প্রথমবার নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন। বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড "রয়্যাল সোসাইটি"র উদ্দেশ্যে ভাষণে ডক্টর সি ভি রমনের স্পেকট্রোস্কোপি সম্বন্ধে বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। রয়্যাল সোসাইটির পক্ষ থেকে সি.ভি রমনকে 'নাইটহুড' সম্মানে ভূষিত করা হয়। আলোর ফোটন কণা আবিষ্কারেও তাঁর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। গভীর সমুদ্রের নীল জল থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণা এই বিজ্ঞানীকে তাঁর জীবনের দিশা খুঁজে দিয়েছিল, এবং তিনি সকল অনুসন্ধিৎসু শিক্ষার্থীদের এগিয়ে যাওয়ার পথকে সুগম করতে সেখানে মুক্ত ছড়িয়ে দিয়েছেন সারা জীবন ধরে।