জীবনবোধ ও বুদ্ধিমত্তার মিশেলে গড়ে তুলেছিলেন গোয়েন্দা চরিত্রকে

এই লেখক বিশ্বাস করতেন জীবনবোধে। তাঁর লেখায় বারবার ধরা পড়েছে ধূসর মানুষেরা। ইতিহাস হোক বা গোয়েন্দা তিনি মানুষ গড়েছেন বাস্তব দিয়ে। সৃষ্টি খানিকটা কল্পনাপ্রসূত হলেও বাস্তবের সঙ্গে তার যোগসূত্র না থাকলে তা স্পর্শ করতে পারেনা সাহিত্যকে। এই লেখক ছক ভেঙেছেন বারবার। তবে সেই ছক তাঁর নিজেরই গড়া। তাই নিজে মুখে স্বীকার করেছেন "জীবনকে এড়িয়ে কখনো গল্প লিখিনি"।

তিনি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর গল্প কখনো কিশোর-কিশোরীদের কথা বলেছে, কখনো ইতিহাসের পাতায় আমাদের বিচরণ করিয়েছে, কখনো আবার সূক্ষ্ম অনুভূতিরা ধরা দিয়েছে গোয়েন্দা গল্পের মাধ্যমে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আসলে আমাদের জীবনের টুকরো টুকরো মুহূর্তের কাহিনী শোনায়।

নিজের সাক্ষাৎকারেও লেখক স্বীকার করেছেন তাঁর লেখায় সরাসরি জীবনের প্রভাবের কথা।

গোয়েন্দা গল্প বাঙালির বরাবর বড় প্রিয়। এই গোয়েন্দা গল্পের এক প্রকার সাবালকত্বে উত্তরণ ঘটেছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ব্যোমকেশের হাত ধরে। এই স্রষ্টার হাত ধরে বাঙালি তার প্রথম প্রাইভেট ডিটেকটিভকে খুঁজে পেয়েছিল।

ব্যোমকেশ-এর প্রত্যেকটা গল্পই আসলে সত্যান্বেষণ। কেবলমাত্র রহস্যের সত্যান্বেষণ নয়। নিছক রহস্যের সমাধান নয়। বরং রহস্যের কাহিনীর ভেতর দিয়ে মানুষের মনের ধূসর জায়গায় পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক। নিজের অন্তরের সত্যির অন্বেষণ করিয়েছেন লেখক। নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন ''ব্যোমকেশের কাহিনীগুলি আসলে গোয়েন্দা-কাহিনী নয়। প্রতিটি আপনি শুধু সামাজিক গল্প হিসেবেও পড়তে পারেন। জীবনকে এড়িয়ে কোনদিন গোয়েন্দা গল্প লেখার চেষ্টা করিনি।"

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম বিহারের পুর্ণিয়াতে। দীর্ঘ সময় তিনি কলকাতার বাইরে কাটিয়েছেন। স্পষ্ট করে বললে বাঙালিদের মধ্যে তিনি সেভাবে থাকেননি। ওকালতির কাজে তাঁর বাবা তারাভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পূর্ণিয়া চলে যেতে হয়। বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে উকিল হোক। মোটামুটি সেই পথেই পা বাড়াচ্ছিলেন ছেলেও। কলকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজে স্নাতক পরীক্ষা পাস করেন। তারপর আইন পড়ার জন্য পাটনাতে যান। এদিকে লেখক-এর মনের ভিতর শুরু হয়েছে দ্বন্দ্ব। বই পড়া এবং লেখার অমোঘ আকর্ষণ তাঁকে সাহিত্যের দিকে বারবার টানতে থাকে। এদিকে বাবার ইচ্ছের সম্মান রাখার কথাও চিন্তা করছেন। তাই আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন। কিন্তু সঙ্গে চলতে থাকে নিজের পছন্দের কাজ। লেখালেখি থেকে দূরে কখনোই থাকেননি। সাহিত্যচর্চা করতেন নিয়মিত।

ওকালতি পাস করে কিছুদিন বাবার জুনিয়র হিসেবে কাজ করেছিলেন। নাহ! মন ভরেনি লেখকের। সাহিত্যের টান এমনই। তাই সারা জীবনের পেশা হিসেবে সাহিত্যচর্চাকেই বেছে নিয়েছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।

ওকালতি জীবনে বসুমতি পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয়েছিল তাঁর গল্প। নাম উড়ো মেঘ। তারপর একে একে 'প্রবাসী', 'ভারতবর্ষ'-র মতো পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে তার লেখা।

১৯২৯ সাল নাগাদ পাকাপোক্তভাবে সাহিত্য সাধনায় নিজেকে নিমজ্জিত করেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখার ক্ষেত্রে তার বিস্তার সুবিশাল। সামাজিক, রোম্যান্টিক, ডিটেকটিভ, ইতিহাস-আশ্রয়ী উপন্যাস ও কিশোর গল্প, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তিনি আকাশের মত মেলে ধরেছেন নিজেকে। যথারীতি পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে তাঁর লেখা।

মূলত সিরিয়াস ধরনের লেখায় লিখতেন তিনি। 'চুয়াচন্দন' 'চিত্রচোর'এর মত গুরুগম্ভীর সাহিত্য যে লেখক লিখেছেন তিনি অবলীলায় এটাও লিখেছেন -''শিল্পীর শিরে পিল পিল করে আইডিয়া/ লেখেন যখন পুস্তক তিনি তাই দিয়া/ উইপোকা কয় চলো এবার খাই গিয়া।'' সাহিত্যের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে এমনই অবাধ বিচরণ ছিল তাঁর।

ছেলেবেলা থেকেই সিনেমার সঙ্গে যুক্ত হতে চাইতেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখালেখিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার পর থেকে চিত্রনাট্য লেখার কাজ তাঁকে বড় আকর্ষণ করত। তাঁর প্রত্যেকটি গল্প, উপন্যাস সেভাবেই রচিত। তারপর অর্থনৈতিক অবস্থার চাপ ছিল। তাই বোম্বে গিয়ে সিনেমার চিত্রনাট্য লিখতেন তিনি। অনেক সিনেমার গল্প লিখেছেন। বম্বেটকিজের অফিসের সঙ্গে কাজ করেছেন। তবে খুব বেশি দিনের জন্য নয়। ফরমায়েশি লেখা ছেড়ে সম্পূর্ণ সাহিত্যচর্চায় ডুব দিয়েছিলেন। জীবনের নানান অভিজ্ঞতা তাঁকে দিয়ে আশ্চর্য সাহিত্য সৃষ্টি করিয়ে নিয়েছে। 'গৌড়মল্লার', 'কালের মন্দিরা', 'তুমি সন্ধ্যার মেঘ', 'তুঙ্গ ভদ্রার তীরে',-র মত ঐতিহাসিক উপন্যাস তার কলমকে অমর করেছে। ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রতি লেখকের আশ্চর্য টান ছিল। নিজেই তাই স্বীকার করেছেন ''আমি বাঙালিকে তাহার প্রাচীনের সঙ্গে পরিচয় করাইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছি। বাঙালি যতদিন না নিজের বংশগরিমার কথা জানিতে পারিবে, ততদিন তাহার চরিত্র গঠিত হইতে পারিবে না।"

সাহিত্য চর্চাকে সাধনার মতো করে দেখতেন তিনি। তাঁর সমসাময়িক লেখকরা বলতেন "মানুষ ইতিহাস কম পড়লেও শরদিন্দুবাবুর ঐতিহাসিক উপন্যাস অবশ্যই পড়বে।"

সংস্কৃত ভাষার প্রতি আগ্রহ ছিল তার। শেখার জন্য বেতন দিয়ে পন্ডিত রেখেছিলেন। তাই তৎসম শব্দের ব্যবহার তাঁর লেখায় চোখে পড়ার মতো। জ্যোতিষ চর্চা ও প্ল্যানচেটেও আগ্রহী ছিলেন। নিজেই স্বীকার করেছেন ''it hase become a part of my life।"

১৯৫২ সালে মুম্বাইতে পাকাপাকি থাকতে শুরু করেছিলেন তিনি। শেষ ১৯ বছর সেখানেই কাটিয়েছিলেন। সাহিত্যচর্চা, বই পড়ার মাধ্যমে দিন কেটেছিল তাঁর। ভালো পাঠকই ভালো লেখক তৈরি করতে পারে আজীবন এই বিশ্বাস সঙ্গী থেকেছে তাঁর। সাহিত্যের অনন্ত পথ দিয়ে আজীবন হেঁটেছেন তিনি। আর পাঠকেরা তাঁর সাহিত্য-সৃষ্টির মাধ্যমে সাহিত্যচর্চার পথে আজও হেঁটে চলেছেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...