শিবঠাকুর বা মহাদেব হলেন দেবাদিদেব, মহেশ্বর। অর্থাৎ তিনি দেবতাদেরও দেবতা। এই মহাদেবতা যে মর্ত্যেও পরম শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে এবং ভালোবাসায় পূজিত হবেন সে আর নতুন কী? বিশেষ করে হিন্দুদের কাছে তিনি সর্বাধিক আরাধ্য। শিবঠাকুর আমাদের খুব আদরেরও। ভালোবেসে আমরা তাঁকে "বাবা ভোলানাথ" বলে সম্বোধন করি।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তো কত দেবতারই আরাধনা করেন। কিন্তু মহাদেব ছাড়া অন্য কোনও দেবতাকে "বাবা" সম্বোধন করেন না। আমাদের এই পরম আপন ও প্রিয় দেবতাটির মন্দির সারা ভারতের সব রাজ্যেই আছে। ভক্তরা সেই সব মন্দিরে গিয়ে মহেশ্বরের দর্শন করেন, পূজার্চ্চনা করেন। কিন্তু একই জায়গায় ১০৮ শিব মন্দির জানেন কি কোথায় আছে? চলুন জেনে নেওয়া যাক কোথায় আছে এই একশো আট শিব মন্দির।
একটা নয়, দুটো নয় একেবারে একশো আটখানা শিবমন্দির আছে আমাদের রাজ্যেই। হ্যাঁ, আমাদের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলাতেই রয়েছে একশো আট শিবের মন্দির। তাও আবার এক জায়গায় নয়। পূর্ব বর্ধমান জেলার অম্বিকা কালনা এবং নবাবহাট - এই দুই জায়গাতেই রয়েছে একশো আট শিবের মন্দির। দুই জায়গাতেই এই একশো আট শিবমন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন বর্ধমানের রাজপরিবারের সদস্যরা।
পার্থক্য বলতে নবাবহাটের ১০৮টি শিবমন্দির চৌকোনা ভাবে অর্থাৎ আয়তাকারে এবং কালনার মন্দিরগুলি গোল করে অর্থাৎ বৃত্তাকারে সাজানো। এবং নবাবহাটের মন্দিরগুলির শিবলিঙ্গগুলি কালো কিন্তু কালনার মন্দিরগুলিতে শিবলিঙ্গগুলির ক্ষেত্রে সাদা এবং কালো শিবলিঙ্গের সমাহার রয়েছে। প্রথমে কালনার ১০৮ শিবমন্দির নিয়েই আলোচনা করা যাক।
কালনার এই মন্দিরের প্রকৃত নাম ‘নবকৈলাস মন্দির’। যদিও ২১১ বছর বয়সী এই মন্দিরশ্রেণী লোকমুখে ১০৮ শিবমন্দির হয়ে গেছে। ১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দে বর্ধমানের মহারাজা তেজচন্দ্র এই মন্দিরগুলি নির্মাণ করিয়েছিলেন। এই মন্দিরগুলির গঠনশৈলীতে বাংলার বিখ্যাত আটচালা শিল্পের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। কালনার ১০৮ শিবমন্দির দু’টি বৃহৎ বৃত্তের আকারে নির্মাণ করা হয়েছে। বাইরের বৃত্তে ৭৪টি মন্দির এবং ভিতরের বৃত্তের ৩৪টি।
বাইরের বৃত্তের ৭৪টি মন্দিরে পর্যায়ক্রমে একটি সাদা এবং একটি কালো শিবলিঙ্গ রয়েছে এবং ভিতরের বৃত্তের ৩৪টি মন্দিরের সবগুলোতেই সাদা রঙের শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। তবে ভিতরের বৃত্তের শিবলিঙ্গগুলি বাইরের বৃত্তের থেকে মন্দিরগুলির শিবলিঙ্গগুলির থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট। মন্দিরগুলি আটচালা আকৃতির। প্রত্যেকটি ছোট মন্দিরের চারচালার উপরে ছোট আর একটি চারচালা রয়েছে। ভিতরের বৃত্তের মাঝখানে একটি বিরাট কূপ রয়েছে। মনে করা হয় এখানে গর্ত করে বড় আকারের কম্পাস বসিয়ে জ্যামিতিক ভাবে বৃত্ত মেপে নির্মাণ করার জন্য এই কুয়ো বানানো হয়েছিল। আবার অন্য একদল গবেষকের মতে মন্দিরের পুজোর কাজে যে জলের প্রয়োজন হতো সেই প্রয়োজন মেটানোর জন্যই এই কূপ তৈরি করা হয়েছিল।
এবং মন্দিরে সাদা কালো শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করার কারণ হিসেবে স্থানীয় প্রাজ্ঞজনেরা বলে থাকেন ত্যাগের প্রতীক হিসেবে সাদা শিবলিঙ্গ এবং ভোগের প্রতীক কালো শিবলিঙ্গ - এই হিসেবেই রাজামশাই শিবলিঙ্গগুলি স্থাপন করেছিলেন। তবে মন্দিরের শিলালিপিতে "নবাধিকশত" এই শব্দটি খোদাই করা রয়েছে। এর থেকে অনেক গবেষক এই মত প্রকাশ করেছেন যে এখানে একশো আট নয়, একশো ন'টি শিব মন্দির রয়েছে। এই বৃত্তদুটির বাইরে থাকা অপর একটি শিবমন্দির জলেশ্বর শিবের মন্দিরটিকে একশো নয়তম শিবমন্দির বলে মনে করেন অনেকেই। এই জলেশ্বর শিবের মন্দিরটি একটি পঞ্চরত্ন মন্দির। অর্থাৎ পাঁচ চূড়া বিশিষ্ট একটি শিবমন্দির। তবে এই বৃত্তাকারে নির্মিত মন্দিরশ্রেণি কিন্তু ১০৮ শিবমন্দির রূপেই বিখ্যাত।
এই মন্দির-মালার এক আশ্চর্য বিশেষত্ব হল এক জায়গায় দাঁড়িয়ে এক সঙ্গে চারটির বেশি শিবলিঙ্গ দেখা যায় না। এক সময়ে এই ১০৮টি মন্দিরের পূজার দায়িত্বে বারো জন ব্রাহ্মণকে নিয়োগ করা হয়েছিল। প্রত্যেক পুরোহিত ব্রাহ্মণ ন’টি করে মন্দিরে শিবপূজার দায়িত্ব পালন করতেন। তাদের রাজবাড়ি থেকে বারো আনা করে প্রতিদিন দেওয়া হতো।
বর্ধমান জেলা ও জেলার বাইরে থেকে বহু পুণ্যার্থী এখানে পুজো দিতে ভিড় করেন। শুধু মন্দির দর্শন করতেও আসেন বহু মানুষ – রাজ্য, দেশ, এমনকি দেশের বাইরে থেকেও। অন্য রাজ্যের ভক্তরাও আসেন। দিনভর অগণিত দর্শক এবং ভক্তজনের যাতায়াত লেগেই থাকে ইতিহাস প্রাচীন এই মন্দিরে। সারা বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা এই মন্দিরে পুজো দিতে আসেন।
এবার যাওয়া যাক বর্ধমান শহরের কাছে নবাবহাটের ১০৮ শিব মন্দিরে। এই ১০৮ শিব মন্দিরমালাও বর্ধমানের রাজপরিবারের এক অনন্য শিল্পকীর্তি। এবং নবাবহাটের ১০৮ মন্দির কিন্তু কালনার শিবমন্দির তৈরির আগেই নির্মিত হয়েছিল। প্রায় দুশো একত্রিশ বছর আগে বহু টাকা খরচ করে এই ১০৮ শিবমন্দির গড়েছিলেন বর্ধমানের মহারানী বিষণকুমারী। একশো আট শিবমন্দির নামে হলেও এখানেও আছে একশো ন'টি মন্দির। মালায় যেমন লকেটটা আলাদা করে লাগানো থাকে তেমনি একটি মন্দির একশো আট মন্দিররাজির একটু বাইরে।
১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দিরগুলির নির্মাণ শুরু হয়েছিল আর শেষ হয়েছিল ১৭৯০-এ। এই একশো আট শিবমন্দির তৈরির পিছনে এক মর্মান্তিক কাহিনী রয়েছে। সেই সময় নাকি নবাবহাট অঞ্চলে ভয়াবহ মহামারী দেখা দিয়েছিল। অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল সেই মহামারীতে। প্রচুর মানুষ হারিয়ে ছিলেন তাদের আপনজনকে। এইভাবে স্বজনদের হারিয়ে এই এলাকার বাসিন্দারা শোকে দুঃখে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন। বর্ধমানের মহারানীমা বিষণকুমারী ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু এবং প্রজাদরদী। প্রজারা যাতে কিছুটা হলেও তাদের স্বজন-বিয়োগের শোক ভুলে থাকতে পারে সেই ভেবে তিনি তাদের ঈশ্বরমুখী করে তুলতে চাইলেন।
এমন মনোভাব থেকেই এই নবাবহাটে একশো আটটি শিবমন্দির গড়ে তুলেছিলেন তিনি। জপমালার আদলে ১০৮টি মন্দির চৌকো আকারে নির্মিত হয়েছে। এবং অতিরিক্ত আর একটি, মোট ১০৯টি মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন মহারানীমা। আয়তাকারে সাজানো ওড়িশার বালেশ্বরের মন্দিরের আদলে নির্মিত মন্দিরগুলি প্রতিটি আটচালার। নবাবহাটের মন্দিরগুলির প্রত্যেকটিতে প্রতিষ্ঠিত আছে কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ। মন্দির প্রতিষ্ঠার সময়ে প্রতিটি মন্দিরের সামনে একটি করে বেল গাছ রোপন করা হয়েছিল।
মহা ধূমধাম সহকারে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সারা দেশ থেকে লক্ষাধিক সাধু এসেছিলেন সেই অনুষ্ঠানে এবং তাদের পায়ের ধুলো সংগ্ৰহ করে একটি সোনার কলসীতে রেখেছিলেন মহারানী বিষণকুমারী।
বর্ধমান জেলার এই দুই একশো আট মন্দিরের খ্যাতি এখন ভারত ছাড়িয়ে অন্য দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। পর্যটকদের কাছেও বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। প্রাচীন এই অতুলনীয় স্থাপত্যরাজি আমাদের অত্যন্ত গর্বের।