বিজ্ঞাপনে দেখা যায় চেয়ারের পা ভাঙতে ভাঙতেই তাঁর ব্যাটসম্যানদের উইকেট ভাঙার অভ্যাস তৈরি হয়। হয়ে ওঠেন ইয়র্কার স্পেশ্যালিস্ট, কিন্তু তার ওই ছোট্ট রান আপ! তার রহস্য কী? বাড়ির উঠোন। হ্যাঁ , সেখানে বল করতেই জসসি হয়ে ওঠেন বুম বুম বুমরাহ।
আলস্যে ভরা গ্রীষ্মের বিকেলবেলায় বুমরাহর ক্রিকেট গল্পের সূচনা। আলস্যটা সবাইকে জড়াতে পারে না অবশ্য, বিশেষ করে জসপ্রীতের মতো ছেলেদেরকে তো একদমই না। বাড়ির মধ্যেকার এক চিলতে ফাঁকা জায়গাটাই যার খেলার বিশাল উদ্যান, ঘরের এমাথা-ওমাথাই যার বাইশ গজ। বল পিচ করবার আওয়াজ তাই বাড়ির নিত্যকার শব্দ। তবে সারাদিন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার দায়দায়িত্ব সামলে এসে সেই ঠুকঠুক শব্দ কারই বা ভালো লাগে! দালজিৎ বুমরাহরও লাগেনি। জসপ্রীত বুমরাহর কাছে তাই আদেশ যায়, 'খেলো, বাধা দেব না। শর্ত একটাই, শব্দ করবে না!”
দেওয়াল আর মেঝেটা যেখানটায় মিশেছে, সেখানে বল ফেললে শব্দটা কম হয়, এই দিগন্তরেখার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে ইতঃমধ্যেই। আর কিছু ভাববার দরকার কী! ইয়র্কারের সঙ্গে তাঁর প্রেম নিয়ে যে দিস্তার পর দিস্তা কাগজ ব্যয় হচ্ছে, এই সখ্যতা তো গড়ে উঠেছিল সেদিনই।
মাত্র ১৯ বছর বয়সে সৈয়দ মুশতাক আলি ট্রফির ২০১২-১৩ মৌসুমে গুজরাটের হয়ে অভিষেক হয় জাসপ্রিত বুমরাহর। টুর্নামেন্টের ফাইনালে পাঞ্জাবের বিপক্ষে মাত্র ১৪ রানের বিনিময়ে তিন উইকেট শিকার করে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছিলেন। এই ম্যাচের মধ্য দিয়েই আলোচনায় আসেন তিনি। এরপর একই বছরে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট এবং আইপিএলেও অভিষেক ঘটে তার। আইপিএলে মুম্বাইয়ের হয়ে নিজের অভিষেক ম্যাচ খেলেন ব্যাঙ্গালুরুর বিপক্ষে। অভিষেক ম্যাচে বিরাট কোহলির উইকেটসহ তিন উইকেট শিকার করেছিলেন ৩২ রানের বিনিময়ে। আইপিএলে নিজের প্রথম আসরে মাত্র দুই ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলেও ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শন করে আইপিএলের ২০১৪ সালের আসরেও মুম্বইয়ের দলে নিজের জায়গা বহাল রাখেন তিনি।
আন-অর্থোডক্স বোলিং অ্যাকশনের পাশাপাশি দুর্দান্ত ইয়র্কার, বাউন্সার এবং স্লোয়ার ডেলিভারিতে ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন তিনি। একজন পেসারের মধ্যে যেসব গুণ থাকা প্রয়োজন, সবকিছুই ক্রমশ আয়ত্ত করতে থাকেন তিনি। কঠোর পরিশ্রম করে বলের গতিও বাড়িয়েছেন চোখে পড়ার মতো। সৈয়দ মুশতাক আলি টুর্নামেন্ট দিয়েই তার প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটেছিল, এই টুর্নামেন্ট দিয়েই নিজের কার্যকারিতা বোঝাতে শুরু করেন তিনি। সৈয়দ মুশতাক আলি ট্রফির ২০১৫ এবং ২০১৬ সালের আসরে ১৪ ম্যাচ খেলে ২৪ উইকেট শিকার করেছিলেন মাত্র ১৪.৭৫ বোলিং গড়ে এবং ৬.৬১ ইকোনমি রেটে। ওয়ানডে ফরম্যাটেও সফলতা পেয়েছিলেন বুমরাহ। বিজয় হাজারে ট্রফিতে ১৪ ম্যাচ খেলে ১৫.২০ বোলিং গড়ে এবং মাত্র ৩.৮২ ইকোনমি রেটে ৩৪ উইকেট শিকার করেছিলেন।
ঘরোয়া ক্রিকেটে এমন অসাধারণ বোলিং করার পর তার জাতীয় দলে ডাক পাওয়া সময়ের ব্যাপার ছিল। জাতীয় দলে ডাক পেতে খুব বেশিদিন সময় লাগেনি তার। অস্ট্রেলিয়ার পেস স্বর্গে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ভারতের পেস ডিপার্টমেন্ট সামলানোর জন্য ডাক পড়ে তার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার অভিষেকটা ছিল রোমাঞ্চকর। টি-টোয়েন্টি স্কোয়াডে ডাক পাওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দেন। অস্ট্রেলিয়ায় যখন পৌঁছান, তখন ভারতের শোচনীয় অবস্থা। পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথম চারটিতেই পরাজিত হয় ভারত। এরপর শেষ ওয়ানডেতে অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির পরামর্শে তাকে একাদশে রাখা হয় তাকে। সুযোগ পেয়েই বাজিমাত করেন তিনি। ৪০ রানের বিনিময়ে দুই উইকেট শিকার করে দলের সেরা বোলার ছিলেন ম্যাচে। তার মিতব্যয়ী বোলিংয়ের কারণে শেষপর্যন্ত সান্ত্বনার জয় পায় ভারত। এরপর টি-টোয়েন্টি সিরিজেও দুর্দান্ত বোলিং করেন বুমরাহ।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর থেকেই দুরন্ত বোলিং করে চলেছেন তিনি। প্রথমে শুধু সাদা বলের ক্রিকেট খেললেও ২০১৮ সালে কেপটাউনে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয়। রঙিন পোশাকে দুর্দান্ত বোলিং করার সুবাদে দক্ষিণ আফ্রিকার পেস বান্ধব উইকেটে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ডাক পেয়ে যান তিনি এবং সিরিজের প্রথম টেস্টেই ইশান্ত শর্মা ও উমেশ যাদবকে টপকে সেরা একাদশে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। যার ফলে অনেকের চোখ কপালে উঠে যায়, কারণ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার রেকর্ড ভালো হলেও এক্সট্রা-অর্ডিনারি ছিল না। ২৬ ম্যাচে তার ঝুলিতে ছিল ৮৯ উইকেট।
প্রতিপক্ষের সেরা ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে বুমরাহর পরিসংখ্যান অসাধারণ। টেস্ট ক্রিকেটে তার বোলিং গড় ১৯.২৪। তিনি টপ-অর্ডার হতে শুরু করে লোয়ার-অর্ডার পর্যন্ত সবার বিপক্ষেই সফল। পেয়ে গিয়েছেন ১০০ টেস্ট উইকেট। প্রথম সারির সাত ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে তার বোলিং গড় ছিল ১৯.৭৮ এবং স্ট্রাইক রেইট ৪৬.৩। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে গত ১৫ বছরে প্রথম সারির সাত ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে কমপক্ষে ৪০ উইকেট শিকার করেছেন এমন বোলারদের শুধুমাত্র বুমরাহর বোলিং গড় ২০-এর কম।
আরও একটি পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে যে, জাসপ্রিত বুমরাহ কতটা স্পেশাল। বিশ্ব ক্রিকেটে এমন অনেক বোলার আছে যে তারা শুধুমাত্র ডানহাতি ব্যাটসম্যান কিংবা বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে ভালো বোলিং করেন। বুমরাহ এদিক থেকেও অনন্য। তিনি দুই ধরনের ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষেই সফলতা লাভ করেছেন।
টেস্ট ক্রিকেটে ৬২ উইকেটের মধ্যে ৩৮টি উইকেট নিয়েছেন ডানহাতি ব্যাটসম্যানের এবং ২৪ উইকেট নিয়েছেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের। ডানহাতি ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে তার বোলিং গড় ১৬.৪৭ এবং বাঁহাতিদের বিপক্ষে ২২.৫৪। ওয়ানডে ক্রিকেটেও ডানহাতি এবং বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে সমানভাবে সফলতা পেয়েছেন। ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে ২০.৬৩ বোলিং গড়ে ৬৩ উইকেট এবং বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে ২১.৮২ বোলিং গড়ে ৪০ উইকেট শিকার করেছেন।
গত ৮০ বছরে টেস্ট ক্রিকেটে পাঁচ উইকেট পাওয়া ইনিংস গুলোতে তার চেয়ে কম বোলিং গড় আছে মাত্র দুজনের। টনি লক তার পাঁচ উইকেট পাওয়া ইনিংসগুলোতে গড়ে রান দিয়েছেন ৬.৬৩ এবং স্টিভ হার্মিসন দিয়েছেন ৬.৯১ রান করে। স্ট্রাইক রেটের দিক দিয়েও তিনি বেশ এগিয়ে আছেন। মাত্র ১৮.৬ স্ট্রাইক রেট নিয়ে তালিকায় পঞ্চম স্থানে অবস্থান করছেন। তার উপরে আছেন স্টিভ হার্মিসন (১৬.৩), ভেরনন ফিল্যান্ডার (১৬.৯), ইরফান পাঠান (১৭.৪) এবং শ্যানন গ্যাব্রিয়েল (১৭.৭) স্ট্রাইক রেট নিয়ে।
এটা সত্যি যে, বুমরাহ এখন পর্যন্ত যা টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন সবকটি ছিল পেস বান্ধব আবহাওয়াতে। তবে পেস সহায়ক হলেও কন্ডিশন ছিল ভিন্ন। সব কন্ডিশনেই নিজেকে প্রমাণ করেছেন তিনি। এখন ঘরের মাঠে ঘরের ছেলে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের কীভাবে নাস্তানাবুদ করেন, সেটাই দেখার বাকি রয়েছে। উপমহাদেশে রঙিন পোশাকে দুর্দান্ত বোলিং করলেও এখন টেস্ট খেলা হয়নি তার। এখনও ক্যারিয়ারের দীর্ঘ সময় বাকি আছে। যদি ইনজুরি-মুক্ত থেকে খেলা চালিয়ে যেতে পারেন তাহলে ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করতে পারবেন।