বাংলার জলপরী বুলা চৌধুরী

খুব ছোট থেকে বয়সে সাঁতার কাটা শুরু করেছিলেন তিনি। তখন মাত্র ২ বছর। ৫ বছরে বাবা শ্রীরামপুর সুইমিং ক্লাবে ভর্তি করে দেন। বাড়ি থেকে অনেক দূরে রোজ বাসে, ট্রেনে করে যেতে হত। বাড়ির কাছে কোনও সুইমিং পুলই ছিল না। সুইমিং কস্টিউম পরে পাড়ার পুকুরে নামার কথা তো ভাবতেই পারতেন না! সুইমিং কস্টিউম তো দূরের কথা, একটা মেয়ের ট্র্যাকস্যুট পরাটাই তখন সমাজের চোখে অপরাধ। তাঁর নিজেরও লজ্জা লাগত। ভোর বেলা সাড়ে তিনটে-চারটের সময় উঠে দৌড়তে যেতেন যাতে কেউ দেখতে না পায়। এসব বাধা পেরিয়েই তিনি জয় করেন ইংলিশ চ্যানেল। তিনি বুলা চৌধুরী। ১৯৭০ সালে আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

তাঁদের বাড়িতে একটা পুকুর ছিল। খুব ছোট থেকেই বিভিন্ন জায়গায় যেতেন সাঁতারের জন্য। বাবা বুঝেছিলেন মেয়ের প্র্যাকটিসের প্রয়োজন। তাই পুকুরের চারপাশে পাঁচিল তুলে নিজেই বাঁধিয়ে দেন যাতে কেউ দেখতে না পায় মেয়ে সুইমিং কস্টিউম পরে সাঁতার কাটছে।

তবে একটা সময়ের পর থেকে তিনি বুঝে গিয়েছিলেন । কারণ সুইমিং কস্টিউম তাঁর কাছে ভগবানের মতো। সরস্বতী পুজোর সময় যেমন পড়ুয়ারা বই, খাতা ঠাকুরের আসনে রাখে, তিনি রাখতেন তাঁর কস্টিউম, সুইমিং ক্যাপ, গগল। সেই কস্টিউমকে যখন কেউ কুদৃষ্টিতে দেখত তখন মনে মনে বলতেন, “ভগবান এদের ক্ষমা করে দাও। এরা অবুঝ।” তাঁকে কিছু একটা করতে হবে। সে দিন এরা বুঝবে। তিনি তাঁর পরিশ্রম দিয়ে সেটা করে দেখিয়েছেন।

গঙ্গায় যখন দূরপাল্লার সাঁতার কাটতেন তখন ঘোলা জলে নিশ্চিন্ত থাকতেন তিনি। কিন্তু মাকে একটা তোয়ালে হাতে পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। যাতে তিনি ডাঙায় উঠলেই তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে নিতে পারে। কেউ দেখতে না পায় মেয়ের ভেজা শরীর। কিন্তু তাতেও কি রেহাই মিলত কুদৃষ্টি থেকে?

মেয়ে বলে অনেক নোংরা রাজনীতিও সহ্য করতে হয়েছে। সহ্য করেছেন বললে ভুল হবে, বলা উচিত দেখতে হয়েছে। কারণ সহ্য তিনি করেননি। বরাবর প্রতিবাদ করেছেন। আর সেই কারণেই আরও বেশি চক্ষুশূল হয়েছেন। একে মেয়ে, তায় প্রতিবাদী। তবে তিনি বরাবর এক নম্বর ছিলেন তাই বেশি কিছু করতে পারেনি। তাও যখনই পেরেছেন তাঁর গলা কাটার চেষ্টা করা হয়েছে। সুইমিং পুলে শর্ট ডিসট্যান্সে তিনি অর্জুন পেয়েছেন। কোনও ছেলে আজ পর্যন্ত পায়নি। এ জন্য বলা হয়েছিল, “কীভাবে অর্জুন পাও তুমি দেখে নেব।”

তখনই ঠিক করে নিয়েছিলেন এমন একটা কিছু করতে হবে যা কোনও ছেলেও করে দেখাতে পারেনি। এ রকম আরও অনেক ঘটনা রয়েছে। এমনকী, তিনি বিয়েটাও করেন এমনই একটা ঘটনায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে। ২৩ বছর বয়সে যখন বিয়ে করেন তখনই তাঁর স্বামীকে বলে নিয়েছিলেন, “সাঁতার আমার প্রথম প্রেম। তারপর আমি অন্য কাউকে ভালবাসি। সাঁতার ছাড়া আমি ভাল থাকব না। আর নিজে ভাল না থাকলে আমি কাউকে ভাল রাখতেও পারব না”।

মেয়েদের লড়াইয়ের অন্যতম প্রতীক বুলা চৌধুরীকে অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। তাই তিনি বলেন, “এখন সমাজ অনেক বদলেছে। কিন্তু এখনও অনেক বাকি। দেখিয়ে দিয়েছে মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি নয়। বিয়ে করে স্বামী, সন্তান নিয়ে সংসার করাটাই তাদের একমাত্র কাজ নয়। মেয়েরা সব কিছু করতে পারে”।

তিনি সকলকে বলতে চান মানুষকে প্রতিভা দিয়ে বিচার করুন। ছেলে বা মেয়ে দিয়ে নয়। যার প্রতিভা রয়েছে, পরিশ্রম করলে সে একদিন সফল হবেই। তিনি মনে করেন শুধু পাখির চোখে লক্ষ্য স্থির রাখতে, আর পরিশ্রম করতে, কারণ নাথিং ইজ ইমপসিবল।

প্রসঙ্গত, বুলা চৌধুরী পাঁচ বছর বয়েস থেকে হুগলী জেলার শ্রীরামপুরে সাঁতার প্রশিক্ষণ নেন তাঁর বাবার তত্বাবধানে। নয় বছর বয়সে প্রথম জাতীয় প্রতিযোগিতায় নেমে ৬টি বিভাগে ৬টি স্বর্ণ পদক জেতেন। ১৯৯১ সালে তিনি সাউথ এশিয়ান ফেডেরেশান গেমসে উনি ৬টি সোনা জেতেন। ১৯৮৯-এ তিনি দুরপাল্লার সাঁতার শুরু করেন এবং সেই বছরই ইংলিশ চ্যানেল পার হন। তিনি খেলরত্ন ও অর্জুন পুরস্কারও পেয়েছেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...