সবেব সত্তা সুখীতা ভবন্তু

"এমন পূর্ণিমা দিনে লুম্বিনী উদ্যানে

বৃদ্ধাঙ্কুর জন্ম নিল অতি শুভক্ষণে।"

আজ থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগে এই দিনে জন্ম নিয়েছিলেন মহামতি বুদ্ধদেব। শুধু জন্মের শুভক্ষণটি নয়, এদিনেই ঘটেছিল তাঁর বোধিজ্ঞান, এমনকি জীবনের শেষ ধাপ মহাপরিনির্বাণ ও ঘটেছিল আজকের দিনটিতে। লুম্বিনী থেকে শুরু হয়ে বুদ্ধগয়া হয়ে কুশিনগরে এই মহা পরিক্রমার সমাপ্তি। তাই বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের কাছে স্মৃতিবিজড়িত এই বৈশাখী পূর্ণিমা বুদ্ধ পূর্ণিমা নামে খ্যাত।

ত্রিপিটকে উল্লেখ আছে, জগৎ অনাচার, পাপাচারে নিমজ্জিত হলে জগতের কল্যাণে এবং মানুষকে জীবনের সঠিক পথ দেখাতে জীবের দুঃখমোচনে মহামানবের আবির্ভাব ঘটে। ভারতবর্ষে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ জাত-পাতের চরম বৈষম্য, ধর্মের নামে প্রাণযজ্ঞ আর হিংসায় মানুষ যখন মেতে উঠল, মানুষকে আলোর পথ দেখাতে বুদ্ধ ধরায় এসেছিলেন। তিনি মানুষকে কেবল মানুষ হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি বলতেন- "সবেব সত্তা সুখীতা ভবন্তু"। তাঁর সাধনা ও সুখ কামনা ছিল সব প্রাণীর জন্য। তাঁর জন্ম নিয়ে কত কাহিনী প্রচলিত।

আজ থেকে প্রায় ২৫৬৩  বছর আগে। তখন কপিলাবস্তু নগরে আষাড়ী পূর্ণিমা উৎসব চলছিল। আষাড়ী পূর্ণিমা শেষে রাণী মহামায়া ঘুমিয়ে পড়লেন। শেষ রাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন চারদিক থেকে চার দিকপাল দেবতা এসে তাকে শয্যাসহ হিমালয়ের এক মনোরম স্থানে নিয়ে গেলেন। তাঁদের মহিষীরা এসে মায়াদেবীকে মানস সরোবরে স্নান করালেন এবং দিব্যবস্ত্র পরালেন।

সেখানে রৌপ্যময় এক পর্বত, তার ওপরে সোনার প্রাসাদ। সেখানে রাণীকে তাঁরা সোনার পালঙ্কে পূর্বদিকে মাথা রেখে শুইয়ে দিলেন। তারপর পাশের সোনার পর্বত থেকে এক সাদা হাতি নেমে এলো। সেই সাদা হাতির শুঁড়ে ধরা ছিল একটি শ্বেতপদ্ম। হাতি প্রাসাদে এসে রাণীর শয্যা তিনবার প্রদক্ষিণ করে শ্বেতপদ্মটি রাণীর জঠরের দক্ষিণ দিকে প্রবেশ করিয়ে দিল। রাণীর দেহমনে এক অপূর্ব শিহরণ খেলে গেল।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে রাণী তাঁর স্বপ্নের কথা রাজাকে জানালেন। রাজা সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতিষীদের ডেকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে বললেন। তাঁরা বললেন, মহারাজ আনন্দ করুন, মহারাণীর পুত্রসন্তান হবে। আপনার এই পুত্র ভবিষ্যতে মহাতেজস্বী ও যশস্বী মহাপুরুষ হবেন। 

এভাবেই দিন যেতে যেতে একদিন রাণীর পিতৃগৃহে যাওয়ার ইচ্ছে হল। রাজা সব ব্যবস্থা করলেন। কপিলাবস্তু থেকে দেবদহ পর্যন্ত পথ নানা সাজে সজ্জিত  হল। রাণী মহামায়া সহচরী সহ সোনার পালকিতে চড়ে পিত্রালয়ে চললেন। রাণীর নির্দেশে দুই নগরীর মধ্যবর্তী লুম্বিনী কাননে (বর্তমান নেপাল) শালগাছের এক মনোরম স্থানে পালকি থামলো। সেখানেই তাঁর প্রসব বেদনা শুরু হল।

সহচরীরা চারিদিক কাপড় দিয়ে ঢেকে দিল। সেই লুম্বিনী কাননে শুভ বৈশাখী পূর্ণিমায় ভাবী বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন। কথিত আছে জন্মের পরপর তিনি সাত পা হেঁটে যান এবং সাত পায়ে সাতটি পদ্মফুল ফোঁটে। এরপর নাকি দৈববানী হয় "আমি অগ্র, আমি শ্রেষ্ঠ, এই আমার শেষ জন্ম"

জীবনের পরম সত্য জানার জন্য তিনি ২৯ বছর বয়সে সংসার ত্যাগ করেন। সত্যের সন্ধানে ভ্রমণ করতে করতে এক সময় তিনি গয়ার উরুবেলায় (বুদ্ধগয়া) গিয়ে নিবিষ্টচিত্তে সাধনামগ্ন হন। দীর্ঘ ছয় বছর অবিরাম সাধনায় তিনি লাভ করেন সম্যক বুদ্ধত্ব। তখন থেকেই তিনি বুদ্ধদেব। সেদিনও ছিল বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথি।

তারপর তিনি ৪৫ বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ধর্মপ্রচার করেন। জীবনের শেষ অধ্যায়ে তিনি রাজগৃহ থেকে কুশীনগর গমন করেন। কুশীনগরের কাছে পাবা নগরে উপস্থিত হয়ে তিনি হটাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন।  শালবনে শালগাছের নিচে শয়ন করেন। তখন আকাশে বৈশাখী পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। ডাকলেন সমস্ত ভিক্ষু দের, আগত ভিক্ষুদের উদ্যেশে তথাগত বললেন জীবনের চরম সত্য। "হে ভিক্ষুগণ! উৎপন্ন হওয়া জীবমাত্রই ক্ষয় অবশ্যম্ভাবী। তোমরা নিজ নিজ কাজ করবে।" মহাপরিনির্বানের পথে এই তার শেষ বাণী।

কবি জীবনানন্দ দাস বলেছেন-এই পৃথিবীর পথে আড়াই হাজার/বছর বয়সী আমি;/ বুদ্ধকে স্বচক্ষে মহাপরিনির্বাণের আশ্চর্য শান্তিতে/ চলে যেতে দেখে- তবু অবিরল অশান্তির দীপ্তি ভিক্ষা করে।

বুদ্ধদেব শিখিয়েছিলেন কি ভাবে মানুষ পরিপূর্ণ শান্তি লাভ করতে পারে। এই দুঃখের সাগরের মধ্যে থেকেও কিভাবে সুখের খোঁজ মেলা সম্ভব। আজ এই সমাজে দাঁড়িয়ে মনে হয় খুব বেশি প্রয়োজন মহামানব বুদ্ধের অহিংসা নীতিকে অনুধাবন করা। সমগ্র বিশ্বে শান্তি স্থাপন করতে হলে সর্বপ্রথম ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক প্রবর্তিত সর্বজনীন  পঞ্চশীলের নীতিকে বিশেষভাবে গ্রহণ ও পালন করতে হবে। আমরা যদি প্রাত্যহিক জীবনে পঞ্চশীল (প্রাণীহত্যা না করা, মিথ্যা কথা না বলা, চুরি না করা, ব্যভিচার না করা ও মাদকদ্রব্য সেবন না করা) গ্রহণ ও পালন করতে পারি তবেই বিশ্বশান্তি স্থাপিত হবে। যা সমাজ ও জীবনের জন্য অত্যন্ত জরুরী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...