আর কদিন বাদেই সরস্বতী পুজো, সকাল থেকেই চলবে স্কুলে কলেজ হৈচৈ, বাসন্তী শাড়ি আর হলুদ পাঞ্জাবির চকিতে দৃষ্টিবিনিময়, হাতে ফুল নিয়ে 'জয় জয় দেবী চরাচর সারে'-মন্ত্রোচ্চারণে, উৎসবের মরসুমে মেতে উঠবে সারা বাংলা। কিন্তু ভাবুন জাপানের এক বৌদ্ধ মন্দির, সেখানে একজন বৌদ্ধসাধক নিবিড় মনে সরস্বতীর সাধনা করছেন, দৃশ্যটা কল্পনা করতে একটু অসুবিধে হচ্ছে কি? আসলে সেই সাধক যাঁর সাধনা করছেন তিনি হলেন বৌদ্ধদের জ্ঞানের দেবী প্রজ্ঞা পারমিতা।
বৌদ্ধ সাধকেরা যে দর্শনের ওপর ভিত্তি করে তাদের সাধনা পদ্ধতির রেখাঙ্কন করেছিলেন তার খানিকটা পরিবর্তন হয় মহাযানীদের আবির্ভাবের পর। মহাযানীরা মনে করতেন যে, গৌতম ছিলেন মানুষের শরীরে বুদ্ধ, যিনি সাধনার মাধ্যমে সম্যক সম্বুদ্ধ হয়েছিলেন, আর মৈত্রেয় হলেন ভবিষ্যৎ বুদ্ধ, তাছাড়াও বোধিসত্ত্ব ও অসংখ্য দেবতারা ছিলেন মহাযানীদের পূজ্য, এর পিছনে ছিল গভীর একটি ভাবনা। মহাযানীরা বিশ্বাস করতেন যে সাধনার প্রথম পর্বে নিবিষ্ট মনে মানুষের মুক্তির কথা চিন্তা করতে হবে, দ্বিতীয় ধাপে ঈশ্বরের রূপ কল্পনা করতে হবে, আর সাধনার শেষ পর্বে যখন সিদ্ধিলাভ হবে তখন সাধক দেবতার যে রূপ কল্পনা করেছিলেন দেবতা সেই রূপেই সাধক কে দর্শন দেবেন। বৌদ্ধরা সেইসময় যে সমস্ত দার্শনিক চিন্তা ভাবনা করতেন সেইসব বোধ বা ভাবনাকেই এক একজন দেবদেবী রূপে স্বীকার করা হতো। বৌদ্ধ সাধকদের জন্য যেসমস্ত কর্তব্য অবশ্য পালনীয় ছিল তা 'পারমিতা' নামে প্রচলিত ছিল, এক একটি পারমিতা ছিল এক একটি গুনের পরমোৎকর্ষ।
দান, শীল, প্রজ্ঞা প্রভৃতি গুণ গুলি উৎকর্ষতা লাভ করে জগৎকারণ পরাশূন্যে, আর যদি কোনো সাধক এই পরাশূন্যের গুণগুলি অভ্যেস করেন তিনিই মোক্ষ লাভ করেন | এই পারমিতা গুলিকে এক একজন দেবী রূপে বৌদ্ধরা কল্পনা করেছিল, এমনকি সাধনার বিভিন্ন স্তরগুলিকেও তারা দেবীর স্থান দিয়েছিলো। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী ভগবান গৌতম বুদ্ধ দশটি পারমিতার অভ্যাস করে মোক্ষলাভ করেছিলেন বা বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে মহাযান বৌদ্ধধর্ম যখন বজ্রযানে পরিবর্তিত হচ্ছিলো তখন মনে করা হতো পারমিতার সংখ্যা দ্বাদশ। বৌদ্ধ সাধন গ্রন্থ ‘নিস্পন্নযোগাবলী’ তে কথিত রয়েছে এই দ্বাদশ পারমিতার মূর্তি কল্পনা। এই পারমিতা দেবীর প্রত্যেকেই ধ্যানীবুদ্ধ রত্নসম্ভবের কুল বিশিষ্ট, এদের রূপগত পার্থক্য তেমন না থাকলেও পার্থক্য রয়েছে এদের বর্ণে এবং দক্ষিণ হাতে অংকিত প্রতীকচিহ্নে, এরা দ্বিবাহু বিশিষ্ট এবং এদের বামহাতে রত্নাঙ্কিত পতাকা। এই পারমিতা দেবীরা হলেন রত্নপারমিতা, দানপারমিতা, শীলপারমিতা, ক্ষান্তিপারমিতা, বীর্যপারমিতা, ধ্যানপারমিতা, উপায়পারমিতা, প্রণিধানপারমিতা, বলপারমিতা, জ্ঞানপারমিতা, বজ্রকর্ম পারমিতা, এবং প্রজ্ঞা পারমিতা। এই দ্বাদশ পারমিতার মধ্যে কেবলমাত্র প্রজ্ঞা পারমিতাই রূপ বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র এবং পারমিতা দেবীদের মধ্যে শীর্ষস্থানের অধিকারিণী। প্রজ্ঞা পারমিতা চতুর্ভূজা, কনকবৰ্ণা। তিনি প্রজ্ঞা বা জ্ঞানের দেবী, প্রজ্ঞার চরম উৎকর্ষতার মূর্তি রূপই হলো প্রজ্ঞা পারমিতা। চতুর্ভূজ দেবী দুই প্রধান হাতে ধর্মচক্র মুদ্রা প্রদর্শন করছেন, অন্য বামহাতে অন্যান্য পারমিতা দেবীদের মতো রত্নাঙ্কিত পতাকা ধারণ করছেন আর অন্য দক্ষিণহাতে ধারণ করছেন পুস্তক।
সৌম্যকান্তি এই দেবীর রূপকল্পনা ব্রাহ্মণ্য দেবী সরস্বতীর সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ্, ভারতবর্ষে আদিমধ্যযুগে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব যখন বৃদ্ধি পেয়েছিলো তখন বজ্রযানীরা ব্রাহ্মণদের প্রতিযোগী হয়ে উঠেছিল এবং তাদেরই দেবদেবীর অনুকরণে বৌদ্ধ দেবদেবীরও কল্পনা করেন, আবার এমনও হয়েছে যে এক তান্ত্রিক বৌদ্ধদেবীর রূপ থেকেই পরবর্তী কালে সৃষ্টি হয়েছে এক ব্রাহ্মণ্য দেবীর, বজ্রযোগিনী থেকেই পরবর্তী সময়ে শাক্তদেবী ছিন্নমস্তার রূপ কল্পিত হয়েছিল বলেই পন্ডিতেরা মনে করেছেন, তবে সাধারণ মানুষ হয়তো এই ধর্মতত্ত্ব বা তার ওপর ভিত্তি করে সৃষ্ট দেবদেবীর রূপের মধ্যেই খুঁজে নিয়েছে ভিন্ন ধরণের জীবন দর্শন কে, একজন জাপানি সাধক এবং একজন সনাতনী ভারতীয় হয়তো একই জীবন দর্শন থেকে দুই দেশে দুই দেবীর সাধনা করে চলবেন।