সাহেবি হিলস্টেশন মুসৌরি

বর্তমানের ট্রেন্ড ‘অনু পরিবার বা নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি’র কনসেপ্টে স্বামী স্ত্রী আর বাচ্ছা নিয়ে সংসার। সুখ দুঃখ সবই ভাগ হয় দু’তিনজনের মধ্যে। সুখ ভাগ করার ভয়েই মানুষ যেন দূরে সরে গিয়েছে। দুঃখের সাথীও আজ তাই দুর্লভ। মানুষের মনে বাসা বেঁধেছে একাকীত্ব, অবসাদ, দুঃখ, যন্ত্রনা। দুঃখ ভোলার তাগিদেও মানুষ কাছে-দূরে, পাহাড়ে-সমুদ্রে দুদিনের জন্য বেরিয়ে পড়ে। মনের সংগোপনে অবসাদের বাস তা দূর করার দাওয়াই যে ভ্রমণ তা বাঙালি হাড়েহাড়ে বুঝেছে।

একটা সময় মানুষ রোগের নিরাময় করতে  বেরিয়ে পড়ত পশ্চিমে। আজকে মানুষের বেরিয়ে পড়তে গেলে অজুহাত লাগে না। কারণ জীবনটাই যেখানে রুগ্ন সেখানে অজুহাত বাহুল্যমাত্র। আর অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় বাঙালির অজুহাতের বালাই নেই। "খাই না খাই বেড়াতে যাই" মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী তারা।

কয়েক বছর আগে  এক পুজোতে আমাদের গন্তব্য ছিল মুসৌরি । হরিদ্বার থেকে গাড়ি বা বাসে  বেরিয়ে পড়লে একদিনেই পৌঁছে যাওয়া যায় মুসৌরি।

আমরা যেহেতু আগে চক্রাতা গিয়েছিলাম তাই দুটো রাত চক্রাতায় কাটিয়ে  আরেক শৈলরানীর  দরবারে  যাওয়ার তোড়জোড়। গাড়ি ছুটে চলেছে মুসৌরির দিকে চেনা পথে।

এক কালের পাহাড়ের রানীর বয়স হয়েছে।গরিমা অনেকটাই ম্রিয়মান। প্রকৃতির গায়ে থাবা বসিয়েছে আধুনিকতা। তবু দূষণমুক্ত বাতাস, রজতশুভ্র পর্বতশৃঙ্গের আবেদনে  এখনও হাজার হাজার পর্যটক মুসৌরিতে ভিড় জমান।

দেরাদুন থেকে  ৩৪ কিলোমিটার দূরে এই শৈলশহর। পাকদন্ডী রাস্তা আর বাঁক। বাঁকে বাঁকে হারিয়ে যাওয়ার হাতছানি। গাড়ি যতই উপরে উঠতে থাকে প্রকৃতির রূপের পরিবর্তন চোখে পড়তে থাকে।  গাড়োয়াল হিমালয়ের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র মুসৌরি  সাহেবদের হাতে গড়া। তাই  সাহেবি ছাপ সব জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়। সাহেবি কেতায় তৈরি বাংলো আজও দেখা যায় মুসৌরির  পাহাড়ের ঢালে। সবুজ শাল, ওক, পাইন গাছে ছাওয়া  পাহাড়ি রাস্তায় ক্রমশ ঠান্ডার আমেজ অনুভূত হতে থাকে। হঠাৎ ঝপ করে গাড়ি এসে পৌঁছায় শৈল শহর মুসৌরিতে।

পশ্চিম থেকে পূর্ব  পর্যন্ত বিস্তৃত ম্যাল। পশ্চিমদিকে ক্লাউড এন্ড আর পূর্বে রকভিলা  (ভূতের বাড়ি) তার উপর থেকে দেখা যায় তুষার ধবল গিরিশৃঙ্গ। যদিও ম্যাল সম্পর্কে ভিন্নমতও রয়েছে।

সাইট সিয়িং করার জায়গা অঢেল। যদিও পাহাড় সম্পূর্ণভাবেই একটি সাইট। তবু পায়ে পায়ে একটু ঘুরে বেড়ানো যেতেই পারে। ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে খাড়াই রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে লালটিব্বা। ওখান থেকেই দেখা যায় বান্দরপুঁছ আর গঙ্গোত্রী শিখরমালা। নীচে দুন ভ্যালি। বিখ্যাত রাস্তা ক্যামেলস ব্যাক রোড। অলস শীতের দুপুরে হোটেলে না ঘুমিয়ে পায়ে পায়ে হেঁটে বেড়ানো যেতেই পারে  ক্যামেলস ব্যাক রোড ধরে। অ্যাডভেঞ্চারে আগ্রহীরা  একটু উত্তর ঢাল বরাবর এগিয়ে দেখে নিতে পারেন যমুনার শাখানদী আগলার। নীল স্বচ্ছ জল কাচের মতো। গাড়ি নিয়ে গেলে বারো কিলোমিটার দূরে কেম্পটি ফলস।

অসাধারণ একটি ঝর্ণা। তবে এই ঝর্ণার আশপাশ বেশ কৃত্রিমতায় মোড়া। পাহাড়ি  ঝর্ণা তবু স্নান করা যায় আর বেশ  জলকেলী করা যাকে বলে তা বেশ উপভোগ করেই করা যায়। ছয় কিলোমিটার দূরে ভাট্টা জলপ্রপাত,  আট কিলোমিটার দূরে বেনং হিল।সেখানে জ্বালাজি মন্দির রয়েছে যা দেখে নেওয়া যেতে পারে ও ঝারিপানি জলপ্রপাত এই বিউটিস্পট গুলো দেখে নেওয়া যেতেই পারে। কেনাকাটা করার জন্য মুসৌরির কুলরি বাজার বা লাইব্রেরি বাজার বিখ্যাত।

মুসৌরির প্রাণকেন্দ্র ম্যাল। বাজার দোকানপাট সব ম্যালে। আর হোটেলের সারি। আমরাও ম্যাল রোড়ের হোটেলেই ছিলাম। তবে আগে থেকে বুকিং করে যাওয়াই ভালো। ম্যাল রোডের উপরে কেচিরি। একটু হাঁটা পথে  গানহিল পয়েন্ট। অনেকে অবশ্য রোপওয়ে দিয়েও  পৌঁছে যান গানহিল পয়েন্ট থেকে অনিন্দ্যসুন্দর শৃঙ্গ আর দুন উপত্যকার নৈসর্গিক দৃশ্য নয়নাভিরাম।

আজকের মুসৌরি অনেকটাই ঘিঞ্জি। হোটেলে হোটেলে ছয়লাপ। সব রকম দামের হোটেল রয়েছে। আগে থেকে বুকিং করলে একটাই সুবিধা যে লটবহর নিয়ে হোটেল খুঁজতে হয় না।

 খাওয়া দাওয়া নিয়ে মুসৌরিতে কোনও সমস্যা নেই। সব রকমেরই খাবার পাওয়া যায় ম্যালের আনাচে-কানাচে। নামিদামি রেস্তোরাঁর সমাহার। উত্তর ভারতীয় খাবারের প্রচলন বেশি স্বাভাবিকভাবেই।

দু তিনদিনের মধ্যে মুসৌরির পাট চুকিয়ে আবার চরৈবতী। এগিয়ে চলার শেষ নেই। তাই গাড়ি এগিয়ে চলে পাহাড়ি পথের পাকদন্ডী বেয়ে। পাহাড়ি নদী, ঝর্ণা আর  উত্তুঙ্গু পর্বত শিখরকে সফরসঙ্গী করে বাঙালির সফরনামা চলতেই থাকে, চলতেই থাকে...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...