সুন্দরবনের বসতির গল্প

ভাটির দেশের জীবনকে তছনছ করে দিয়ে গিয়েছে ১৯৫ কিমি বেগের এক ঝড়। নাম তার আমফান। সাত ঘন্টার টানা তাণ্ডবের পর সে চলে গিয়েছে, কিন্তু রেখে গিয়েছে ঘর, ভিটে, বসত, জীবন হারা দগদগে ক্ষত। জল- জঙ্গলের সঙ্গে প্রতিদিন যুদ্ধ করে টিকে থাকা অসহায় মানুষগুলো জানে না কতদিন, কত বছর অপেক্ষার পর আবার বরদা হয়ে উঠবে প্রকৃতি। হারানো হাসি ফিরে আসবে আর্ত জীবনে। সাগরের লোনা জলে তাদের চোখের জল আর আলাদা করে চেনা যায় না। প্রতি ঝড়ের উচাটনে দু’চোখ যেন কবেই শুকিয়ে খটখটে। নতুন করে বান ডাকে না সেখানে।

ডব্লিউইডব্লিউইএফ- এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪.৫ মিলিয়ন মানুষ বাস করে দ্বীপভূমিতে। জলে কুমীর, ডাঙায় বাঘ, সঙ্গে সদা খড়্গহস্ত প্রকৃতি। কখন যে কার রোষে পড়তে হয় সুন্দরবনবাসী আন্দাজটুকুও পায় না। বিপন্ন প্রাণ, বিপন্ন জান- প্রতিটা মুহূর্তে। যেন প্রাণ ভোমরাটি অনিশ্চিত হাওয়ায় ভাসিয়ে রেখে যুঝে যাওয়ার এক রোখা চেষ্টা। এক অসম যুদ্ধ চলছে সারাক্ষণ, কে জিতবে মানুষ না প্রকৃতি কেউ জানে না।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে তাহলে এমন বিপদের ঘরে বাস করে কেন মানুষ?

অনিবার্য উত্তর আসে, ‘ তাহলে যাব কই?’

ভাটির দেশে কীভাবে গড়ে উঠল বসতি?

আজ যেভাবে সুন্দরবনকে দেখতে চোখ অভ্যস্ত তার কৃতিত্ব অনেকটাই ইংরেজ রাজ শাসকের। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে তিন ইংরেজ প্রশাসকের নিরলস চেষ্টাতেই গড়ে ওঠে দ্বীপভূমের মানব আবাদ।

যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের পতনের পর দীর্ঘদিন সুন্দরবন সাধারণের অগম্য ছিল। জন মানুষের নজর আন্দাজের বাইরে প্রান্তিক অরণ্য অঞ্চল।

১৭৭০-১৭৭৩ সাল নাগাদ চব্বিশ পরগনার কালেক্টর মিস্টার ক্লড রাসেল সুন্দরবনের কিছু অঞ্চল ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইজারা দেওয়া শুরু করেন। লক্ষ্য রাজকোষের আয় বৃদ্ধি।

এই ইজারার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল- বন্দোবস্ত পাওয়া জমির ওপর প্রথম সাত বছর কোনও খাজনা দিতে হবে না। সাত বছর পর জমির গুণগত মান অনুসারে পরের বছর মানে আট নম্বর বছরে বিঘা প্রতি ১২, ৮ এবং ৬ আনা খাজনা দিতে হবে। প্রতি দশ বছর অন্তর আবাদিকৃত অতিরিক্ত জমিকে এই বন্দোবস্ত এর অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই সব তালুক অঞ্চলের ওপরের প্রথম সুন্দরবনের জরিপ করা হয় ইংরেজ প্রশাসনের উদ্যোগে। তার ভিত্তিতেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। তবে রাসেলের ভূমি ব্যবস্থা খুব একটা সফল হয়নি। দেওয়ানি লাভের পর বাংলায় সমস্ত জমির ওপর কোম্পানির শাসন কায়েম হয়।

১৭৮১ সালে টিলম্যান হেঙ্গেল সুন্দরবনের সুপারিনটেনডেন্ট হয়ে আসেন। তিনিই ছিলেন আবার যশোরের প্রথম জজ সাহেব। মূলত তিনিই প্রথম সুন্দরবনের যথার্থ হিতে নজর দেন। ভূমি সংস্কার ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, জীবনযাত্রা, ব্যবসা বাণিজ্য, কৃষি, গ্রাম উন্নয়ন সমস্ত দিক নিয়ে সুচিন্তিত ভাবনা গড়ে তোলেন। এই সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব সুন্দরবনকে ছোট ছোট প্লটে ভাগ করে জন সাধারণের মধ্যে বিতরণের পরিকল্পনা নেন। সামগ্রিক পরিকল্পনার  নাম দেওয়া হয় ‘ সুন্দরবন প্ল্যান’। প্রস্তাব যায় তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস-এর কাছে।  এমন প্রস্তাব পাশ হতে বেশি সময় লাগেনি। পাঠানোর ঠিক দু’মাসের মাথায় ছাড়পত্র মিলে যায়। তিনি প্রস্তাব পেশ করেন ১৯৭৮৩ সালের শেষ ডিসেম্বরে। অনুমোদন মেলে ১৭৮৪- এর ফেব্রুয়ারির একেবারে গোড়াতেই।

সুন্দরবনের ৬৪,৯২৮ বিঘা জমিকে ১৪৪টি তালুকে বিভক্ত করে দেশি- বিদেশি জমিদারদের মধ্যে ভাগ করা হয়। সাত বছরের জন্য সাত লক্ষ টাকা রাজস্ব আদায়ের শর্তে কলকাতার হরিণঘাটা নদী থেকে রায়মঙ্গল পর্যন্ত অঞ্চল হেঙ্গেল সাহেব লিজ নেন। সময়টা সন ১৭৮৩।

দরাজ, দয়ালু মনের এক সিংহ হৃদয় মানুষ ছিলেন তিনি। জলদস্যু আর নীলকর সাহেবদের উৎপাত থেকে গরিব অসহায় মানুষদের রক্ষা করেছিলেন। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোতে তাঁর প্রভাব এতটাই ছিল যে মানুষ বলত হেঙ্গেল সাহেবের নামে বাঘেও ভয় পায়। পরে ওই অঞ্চলের নামই হয়ে যায় ‘হিঙ্গলগঞ্জ’।

তিনি জন আবাদ করলে দলেদলে মানুষ এসে বাসা বাঁধতে থাকে দ্বীপ অঞ্চলগুলোতে। চাষ-আবাদ, মধু সংগ্রহ, কাঠ কাটা, নুন তৈরি নানা রকম পেশায় ছড়িয়ে পড়ল তারা। পেশা অনুযায়ী নামও গেল বদলে।

পরবর্তী কয়েক দশক ধরে সুন্দর বনে ভূমি সংস্কার, কর ব্যবস্থা,  গ্রাম জীবনের সার্বিক উন্নয়ন নিয়ে নানা পরীক্ষা- নিরীক্ষা হয়।

১৯০২ সালে স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন সরকারের কাছ থেকে গোসাবা, রাঙাবেলিয়ার প্রায় ৯ হাজার একর জমি চল্লিশ বছরের জন্য লিজ নেন। নীল চোখের এই অমায়িক সাহেব ছিলেন প্রজা অন্ত প্রাণ। অভাবনীয় সব পরিবর্তন আনেন। দুর্গম অরণ্যের বুকে গড়ে ওঠে সুষ্ঠ পরিকল্পিত স্বয়ং সম্পূর্ণ আধুনিক গঞ্জ ব্যবস্থা। আশেপাশের জেলা থেকে ঋণ, জমিদারের অত্যাচার, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভিটে ছাড়া মানুষ দলে দলে ভিড় করে হ্যামিল্টন সাহেবের আবাদে। নিজের উদ্যোগে, নিজের অর্থে তিনি তাদের সব দেন মিটিয়ে দেন। তাঁর আবাদ থেকে ‘মহাজন’ শব্দটা একেবারে মুছে দিতে পেরেছিলেন। কৃষি খামার, পানীয় জল, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গ্রন্থাগার, ডাকঘর সব কিছু দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন গোসাবাকে। গ্রাম্য বিবাদ মেটাবার জন্য পঞ্চায়েত। এমনকি গোসাবা দ্বীপে চালু হয়েছিল নিজস্ব একটাকার নোট।

এই ইংরেজ শাসক সারাজীবন ধরে গ্রামোন্নয়ন করে গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। তাঁর আমন্ত্রণে কবিগুরু স্বয়ং এসেছিলেন সুন্দরবনের এই দ্বীপটিতে। নিঃসন্তান সাহেব তাঁর সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি দান করে যান গ্রাম উন্নয়নে।

ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ঘেরা বিশ্বের বৃহত্তম এই ব-দ্বীপ অঞ্চলটির বসতির ইতিহাসে এভাবেই জড়িয়ে আছেন নামী, অনামি ভিনদেশি শাসকরা। কারও কারও নাম জড়িয়ে গিয়েছে ভূ-খণ্ডের নামে। আবার কেউ বা বিস্মৃতির অন্তরালে।

ভাঙন ধরা বাঁধ, উথালপাতাল নদী আর ভিটে-মাটি হারানো ভাঙা জীবন। সহায় সম্বলহীন বেঁচে থাকায় গুমরে কাঁদে ভাটির দেশে বসত গড়ে ওঠার গল্প। ভয় মাথায় নিয়ে বছরের পর বছর ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায় জনপদ। দ্বীপ ভাসে। চর ডোবে। আগ্রাসী প্রকৃতির রোষে পড়ে তলিয়ে যায় ঘর-দুয়ার-দাওয়া- অন্নের সংস্থান। জলময় সংসার, তোড়ে ভেসে যায় গৃহস্থালি। ত্রাণ শিবিরে শুকনো চিড়ের রাত কান্না গিলে তেষ্টা মেটায়। তবু ভাটির দেশের মাটি আগলেই পড়ে থাকা। কেউ কোত্থাও নেই, নিয়তির কাছে যেন তাদের যত অভিযোগ...

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...