যে-সব্জিতে সবচেয়ে বেশি বিষ দেওয়া হয়, তা হচ্ছে বেগুন। বাজারে বেগুন কিনতে অনেকেই পোকাধরা বেগুন খুঁজে খুঁজে কিনে আনেন। ভাবেন, এতে নির্ঘাত বিষ দেওয়া থাকবে না, বিষ দিলে কী আর পোকা ধরত! আসলে, এটা কোন যুক্তিই না। বেগুনের পোকারা এমন মারাত্মক যে, কিছুকাল পরে পরেই বিষে তারা অভ্যস্থ হয়ে যায়। কিছুতেই মরতে চায় না। চাষি বিষ দিলে ক্ষেতের সব গাছেই দেয়, কোন গাছকে আলাদা রাখে না। ফলে, পোকা ধরা গাছের বেগুনে যেমন বিষ স্প্রে করেন, তেমনি পোকা না-ধরা বেগুনেও করে। পোকা বেগুন ফেলে দেবার জিনিস, পয়সা দিয়ে এমনিতে কিনবে কে! তাই একটা ধারণা ছড়িয়ে সস্তায় বিক্রি হয়। তাই বাজার থেকে নির্বিষ বেগুন কেনা, আর কাঁঠালের আমসত্ত্ব আনা একই ব্যাপার। বিষ দেওয়ার দশ থেকে পনেরো দিন যে ক্ষেতে বিষ দেওয়া হয়, সেই ক্ষেতের বেগুন খাওয়া চলে না। কিন্তু ব্যবসায়িক চাষে এই নিয়মনীতির তোয়াক্কা কেউ করে না। আজ বিষ দিলে কালকেই ক্ষেতের বেগুন তুলে বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে। তাই বেগুন কিনলে রান্নার আগে জলে অনেকবার ধুয়ে, দীর্ঘক্ষণ ভিজিয়ে রেখে; তার বিষের প্রভাব কমানোর সচেতন চেষ্টা করবেন। আর আপনার ব্যালকনি বা ছাদবাগানে যদি অন্তত গোটা চারেক বাড়তি টব রাখার জায়গা থাকে; তাহলে নির্দ্বিধায় তাতে বেগুনের চাষ করুন। এতে আর যাই হোক, নির্বিষ বেগুন খেতে পাবেন।
সবচেয়ে বড় কথা, যে-সব পোকারা মাটিতে অর্থাৎ ক্ষেতে বেগুন চাষ করলে ফসল ও গাছের খুব ক্ষতি করে; তাদের বেশিরভাগই ছ’সাত ফুটের বেশি উঁচুতে উড়তে পারে না বা উঠতে পারে না। তাই ব্যালকনি বা ছাদবাগানে বেগুন চাষ করলে পোকামাকড়ের উপদ্রব স্বাভাবিকভাবেই বেশ কম হয়। যেটুকু হয়, তাতে বিষ প্রয়োগের কোন প্রয়োজনই পড়ে না। আমি নিজে বিগত তিন বছর ধরে নির্বিষ পদ্ধতিতে আমার ছাদবাগানে বেগুন ফলিয়ে আসছি। লেখার সঙ্গে যে ছবিগুলো দেখছেন, সেগুলো সেই প্রচেষ্টারই সফল নিদর্শন। আজ সেই অভিজ্ঞতাই আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করার চেষ্টা করছি।
আমি সবুজ-সাদা বেগুনের চাষ করি। আপনারা বেশি ফলনের জন্য বেগুনি রঙের যেসব আকারে ছোট কুলি বেগুন কিংবা লম্বাটে দেখতে লাফা বেগুন রয়েছে, সেগুলো চাষ করতে পারেন। এগুলোতে অল্প ক’টা গাছেই প্রচুর ফলন হয়ে থাকে। এছাড়াও আপনাদের পছন্দমতো যে-কোন জাতের বেগুন চাষ করতে পারেন। সব বেগুনের চাষ পদ্ধতি একই। টবে আপনার পছন্দের জাতের চারা পেতে একমাত্র বিশ্বস্ত গাছবিক্রেতার কাছ থেকেই চারা নেবেন। বেগুনের চারাতলা থেকে চারাগুলো উপড়ে আনা হয়ে থাকে। এটাই নিয়ম। এমন চারা দেখে ভয় পাবার কিছু নেই। বেগুন রোপণ-পদ্ধতিতে চাষ হয়ে থাকে। শুধু সুস্থ-সবল দেখে চারা নেবেন, তাহলেই হল। ঠিকভাবে রোপণ করলে একটাও চারা মরবে না। চারাগুলো এনে আধকাপ জলে শেকড় ও কাণ্ড ডুবিয়ে সোজাভাবে দাঁড় করিয়ে রেখে দেবেন, যতক্ষণ না সেগুলো লাগিয়ে ফেলার বন্দোবস্ত করতে পারছেন, ততক্ষণ। ওদের ফ্যানের বাতাসের তলায় বা এসির মধ্যে রাখবেন না। স্বাভাবিক ছায়াযুক্ত কোন একটা জায়গায় রেখে দিলেই হবে।
বাড়িতে বাড়তি দশ-বারো ইঞ্চির টব থাকলে, সেগুলোতে বেগুনের চারা বসাতে পারেন। না থাকলে, কেজি চারেক মাটি ধরে এমন পলিব্যাগ হলেই যথেষ্ট। আমি সবজি চাষ পলিব্যাগেই করি। দেড় ভাগ এঁটেল মাটি, এক ভাগ বালি, দেড় ভাগ পুরনো গোবর সার বা ভার্মি কম্পোস্ট সার দিয়ে বেগুনের জন্য মাটি তৈরি করতে হবে। বেশ মিহি করে এই তিনটে জিনিস একসঙ্গে মেশাতে হবে। মিশ্রিত মাটি ড্রেনেজ সিস্টেম (আগের পর্বগুলোতে বলেছি কীভাবে টবের ড্রেনেজ সিস্টেম ভালো রাখতে হয়) ঠিক রেখে টবের আশি ভাগ ভর্তি করতে হবে। আর পলিব্যাগে কেজি চারেক মিশ্রিত মাটি দিয়ে ভর্তি করে ওপরের দিকটা জামার হাতার মতো সুন্দর করে গুটিয়ে দিতে হবে। ড্রেনেজের জন্য পলিব্যাগের তলার দিকে চার পাশে দুটো করে আটটা ফুটো করে দিতে হবে। এবার টবে ও পলিব্যাগের মধ্যিখানে গর্ত করে তাতে এক চিমটে ফাঙ্গিসাইড দিয়ে একটা করে বেগুনের চারা বসিয়ে দিতে হবে। যথেষ্ট জল দিয়ে গাছ ও মাটি দুইই ভালো করে ভিজিয়ে টবশুদ্ধ গাছটি ছায়ায় রাখতে হবে চারদিন। তারপর দিন দুয়েক রাখতে হবে আধো আলোছায়ায়। তারপর ফুল সানলাইটে। বেগুনের জন্য দিনে পাঁচ থেকে ছ’ঘন্টা ভালো রোদের প্রয়োজন হয়। কম রোদে লগবগেমার্কা গাছ হবে, কিন্তু ফলন হবে না। আর একটা কথা, বেগুন বারো মাস চাষ করা যায়, বারো মাস তা থেকে ফল পাওয়া যায়। একবার গাছ করলে দুই থেকে তিন বছর ফল পাবেন শুধু একটু যত্ন করলেই।
বেগুনের জল ও খাবার দুইই বেশ পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রয়োজন হয়। গাছ যত বড় হবে, তত তার জলের চাহিদা বাড়ে। গরমকালে তার প্রয়োজনীয় জলের জন্য বাড়তি খেয়াল রাখতে হবে। ছোট অবস্থায় দিনে একবার জল দিলেই হবে, গাছে ফুল আসতে শুরু করলে দিনে দু’বার জল দিতে হবে। বেগুন জল বেশি চায় ঠিকই, কিন্তু খেয়াল রাখবেন সব সময় যেন তার মাটি কাদাকাদা না-হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালে জল দেওয়ার অসুবিধে থাকলে টবের ওপর একটা দেড়-দু’লিটারের বোতলে জল ভরে ছিপি এঁটে তাতে ছিপিটা নীচের দিকে রেখে টাঙিয়ে দেবেন। ছিপিটাতে একটা ফুটো করে দেবেন। দেখবেন, তা থেকে এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে কয়েক সেকেন্ড পর পর যেন জল পড়ে টব বা পলিব্যাগের মাটিতে। এখান থেকেই সারাদিনের প্রয়োজনীয় জল গাছটি পেয়ে যাবে। কারণ, কর্মব্যস্ততার জন্য খেয়াল রাখতে না-পারলে গরমের দিনে টব বা পলিব্যাগের মাটি যদি খটখটে শুকনো হয়ে যায়, তাহলে গাছ শকড হয়। ফুল শুকিয়ে যায়, ফলের পরিমাণ কমে যায়, কচি ফল ঝরে যায়। এমনিতে বেগুন গাছের জীবনীশক্তি খুব ভালো; প্রবল জলের আকাল হলেও সে একেবারে মরে যায় না; শেষ অবস্থায় জল পেলেও সে বেঁচে ওঠে। কিন্তু তাতে ফল দেওয়ার ফ্লো-টা ধাক্কা খায়।
শুধুমাত্র জৈব খাবার দিয়ে বেগুনের চাষ করে অল্পই ফলন পাওয়া যায়। তাই বেশি ফলন পেতে রাসায়নিক ও জৈব দুটো পদ্ধতিই আমরা একসঙ্গে প্রয়োগ করবো এই চাষে। বেগুন গাছ মাটিতে ধরে গেলে অর্থাৎ দু’খানা নতুন পাতা মেলেছে; এমন অবস্থা দেখলেই খাবার চালু করতে হবে। সপ্তাহে একবার করে আমাদের সেই চিরপুরাতন ব্যবস্থা অনুযায়ী তিন দিনের খোল পচানো জল পাতলা করে দিয়ে যেতে হবে। এর সঙ্গে প্রতি দশদিন অন্তর একবার গাছ প্রতি ছ’দানা করে ডিএপি সার; পরের বার পনেরোঃপনেরোঃপনেরো রাসায়নিক সার এক চা-চামচ গাছের গোড়া থেকে দূরে মাটি খুঁচিয়ে গোল করে টব বা পলিব্যাগের ধার ঘেঁষে দিয়ে যেতে হবে। এভাবেই রুটিন চলবে। যদি পনেরোঃপনেরোঃপনেরো না-পান তাহলে তার পরিবর্তে দশঃছাব্বিশঃছাব্বিশ দেওয়া যাবে। এটাও জোগাড় করা না-গেলে প্রতি দশদিন অন্তর শুধু ডিএপি দিয়ে গেলেও হবে। রাসায়নিক সারে মাটি রুক্ষ্ম হয়ে যায়, তাই কুড়িদিন অন্তর মুঠো তিনেক করে গাছ প্রতি গোবর বা কম্পোস্ট সার টব ও পলিব্যাগের মাটিতে ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে। মাসে দু’বার চারটে গাছের জন্য হাফ লিটার জলে এক চিমটে ফাঙ্গিসাইড গুলে এক কাপ করে প্রতিটি গাছের গোড়ায় দিয়ে দিতে হবে। এতে গাছের গোড়ায় ফাঙ্গাসের আক্রমণ হবে না বা শেকড় পচে গাছ মরবে না। এটা বেগুন গাছে খুব হয়।
বেগুন গাছের গোড়া সবসময় পরিষ্কার রাখবেন। আগাছা হতে দেবেন না। মাটি সপ্তাহে একবার করে খুঁচিয়ে ঝুরঝুরে রাখবেন। পাতায় যদি শুঁয়োপোকার মতো পোকা দেখেন বা দেখেন গাছের পাতা মোড়ানো মোড়ানো হয়ে রয়েছে, তাহলে মোড়ক খুলে ফেলবেন। তার ভেতরে কালচে শুঁয়োপোকার মতো পোকা পাবেন, তাদের ধরে মেরে ফেলবেন। এরা পাতা ও গাছের রস শুষে খায়। ফলে ঢুকে পড়ে। এদের দমনের জন্য কীটনাশক লাগে না। চোখে পড়লে এদের হাতে মেরেই দমন করা যায়। ভয় নেই, এদের শুঁয়ো শুঁয়োপোকার মতো হাতে লাগলে জ্বালা ধরায় না। কিছুই হয় না। যদিও ছাদ বা ব্যালকনি বাগানে এই পোকার আক্রমণ খুবই কম হয়; হলে ভয় পাবার কিছু নেই। অন্য পোকাদের আক্রমণ একেবারেই হয় না।
টেনে বেশ কিছুদিন ফল দিয়ে বেগুন গাছ অল্পদিন বিশ্রাম নেয়। এই বিশ্রামের সময় জল ও খাবার যেমন নিয়মিত দেওয়া হয়, তেমনই দিয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ যত্নের যেন ত্রুটি না-হয়। তাহলেই দেখবেন অল্পদিনের মধ্যেই সে ফুল ফোটাচ্ছে, ফল দিচ্ছে। একটা কথা মাথায় রাখবেন, প্রতিটি গাছ ফুল ফোটানো আর ফল দেওয়ার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করে। আমাদের শুধু তার উপযুক্ত আয়োজনটুকু করে দিতে হবে এই যা।
বাড়িতে বেগুন ফলানোর এই যে প্রসেস, এটা পাঁচটা বিদেশি ফুল চাষের চাইতে অনেক অল্প আয়াসেই ফলো করা যায়। দেখুন, ফল, ফুল বা সবজি চাষে অহেতুক জটিলতা আমি পছন্দ করি না। চেষ্টা করি, যতটা কমন পদ্ধতিতে এগুলো চাষ করা যায়। আমি চাই চাষটা আমাদের কাছে উদ্বেগবিহীন আনন্দের হয়ে উঠুক, ব্যাকরণের ভিন্ন ভিন্ন সূত্র মনে রাখার মতো নিকষ নীরস একটা পদ্ধতি হয়ে উঠুক, এটা আমি চাই না। বেগুন চাষের ক্ষেত্রেও আমার সেই চাওয়ার অন্যথা নেই। হাতেকলমে একবার করলেই বুঝতে পারবেন, নিজে গাছ করে বেগুন ফলানো তেমন কোন ঝামেলারই নয়। তার ওপর, নিজের ফলানো নির্বিষ বেগুন যখন হরেক সুস্বাদু পদ হয়ে আপনার খাবার থালা সাজাবে; তখন সে অন্য একটা অকৃত্রিম ও আন্তরিক তৃপ্তি আপনার ঠোঁটে ফুটিয়ে তুলবে—যা কোথাও মূল্য দিয়ে পাওয়া যায় না।...