তাঁর জীবনে ওইদিনের সেই ভয়ংকর ঘটনা ঘটে যেতেই পালটে যায় বাকি জীবনটা। সুন্দর সাজানো জীবন কেড়ে নেয় সবকিছু। একদিকে যেমন চলে যায় চাকরি, ঠিক তেমনই তাঁকে ছেড়ে চলে যায় কাছের মানুষজন।
তবে সবকিছু হারিয়েও একবারের জন্যেও নিজের সেই লড়াই থেকে সরে যাননি বারুইপুরের অ্যাসিড আক্রান্ত মমতা গায়েন। একা বেঁচে থাকার সেই লড়াই লড়তেই ছোট্ট ঠেলা গাড়িতে চা-ঘুগনি বিক্রি করছেন বছর পঞ্চাশের এই মহিলা। এই সমস্ত খাবারের সাথে তৈরি করছেন রুটিও। বারুইপুরের উকিলপাড়া এলাকার বাসিন্দা মমতা। প্রত্যেকটা দিন সন্ধ্যেবেলায় ঠেলা ঠেলে পাড়ার মোড়ে গিয়ে বসেন তিনি। সেখানে বসেই রুটি, ঘুঘনি, চা বেচে ফের বাড়ি ফেরেন রাতে।
তবে, প্রথম থেকে এই জীবন মোটেই কাটাটেন না মমতা। ছিল অন্যরকম! একসময় তিনি কলকাতা শহরে এক বেসরকারি সংস্থায় রিসেপশনিস্টের কাজ করতেন। সেই সময় বাড়ির সংসার সামলে রোজ সকালে বারুইপুর থেকে ট্রেন চেপে বালিগঞ্জ আসতেন। সেখান থেকে কর্মস্থলে। তারপর আবার কাজ সেরে ট্রেন চেপে ফিরতেন বারুইপুরের উকিলপাড়ায়।
কিন্তু এরকমই ২০১০ সালে, পালটে গেল সবকিছু! এরকমই একদিন বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। কিন্তু সেদিন ফেরার পথে ট্রেনে অ্যাসিড হামলা হয় তাঁর উপর। এরপর থেকেই আর সবটা এক ছিল না তাঁর জীবনে।
মমতা জানিয়েছিলেন যে এদিন ফেরার পথে রোজকার মতোনই সন্ধ্যাবেলা বালিগঞ্জ থেকে ট্রেন ধরেন। তবে, এদিন ট্রেন ছাড়ার মুখে কিছুটা দৌড়েই মহিলা কামরায় উঠেছিলেন তিনি। ঠিক সেই সময়ই অ্যাসিড ছুড়তে ছুড়তে ওই কামরা থেকে নেমে যাচ্ছিল কয়েকজন দুষ্কৃতী। তখনই মমতার মুখে-শরীরে এসে লাগে সেই অ্যাসিড। তাঁর সাথে সেই কামরায় থাকা আরও ১১জন মহিলা যাত্রীরা জখম হন সেই ঘটনায়। এরপর সেই ট্রেন কিছুটা এগিয়ে ঢাকুরিয়া রেল বসতির কাছে গতি কমাতেই লাফিয়ে নেমে পড়েন তাঁরা। সাথে সাথেই বসতির বাসিন্দারাই সেই জখম মহিলাদের প্রাথমিক চিকিৎসা করেন। এরপর তাঁদেরকে রেল পুলিশ এসে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তবে, ততক্ষণে শেষ! ওই কিছু ঘন্টার মধ্যেই পালটে যায় সেই সকল নারীর জীবন।
প্রায় এক বছরেরও বেশি, বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা চলে মমতার। জানতে পারেন একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায় তাঁর। এই ঘটনাটি ঘটার পর চাকরি চলে যায় মমতার। অন্যদিকে সেইসময়, যাকে পাশে দেখতে পাবেন ভেবেছিলেন, সেও ছেড়ে চলে যায়! ‘সে’ ছিল তাঁর স্বামী।
ফলে, মায়ের সাথেই থাকবে ভাবেন মমতা। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ফেরার কিছুদিনের মধ্যে মৃত্যু হয় বৃদ্ধা মায়েরও। ফের একা হয়ে পড়েন মমতা! সেই সময় নতুন কাজ জোগাড়ের চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু কিছুই পাচ্ছিলেন না। একটাই কারণ বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল, সেটা হল মুখে-শরীরের ক্ষত চিহ্ন ও পোড়া দাগ।
মমতা আরও জানিয়েছিলেন যে সেইসময় তাঁকে লোকজনও এড়িয়ে চলতেন। ফলে, সেইভাবে কোনও কাজই মিলত না। মানসিক রোগেও ভুগছিলেন সেই কারণে, কিন্তু পাশে তো আর কেউই ছিল না। তাই নিজেকেই নিজে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি। ক্রমশ নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। ঘরবন্দি হয়ে পড়ছিলেন তিনি। সেই সময় দাদার পরিবারের তরফ থেকে একবেলা খাবার মিলত। সেই খাবার দিয়েই কোনওরকমে পেট চালাতেন তিনি।
এরপর তিনি বারুইপুরেই অ্যাসিড আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করা এক সংগঠনের হাত ধরে নিজের ঘর থেকে ফের বেরোন। সেখানে অ্যাসিড আক্রান্ত আরও মহিলাদের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হন। ধীরে ধীরে তাঁর মনে ফের আত্মবিশ্বাসটি জেগে ওঠে।
এরপরেই নিজে কিছু করার সেই ইচ্ছে থেকেই তৈরি করে ফেলেন একটি ঠেলা গাড়ি। এরপরেই শুরু হয় তাঁর আরও এক জীবন। সেই ঠেলাগাড়ি নিয়েই রোজ বিকেলে বাড়ির কাছে পাড়ার মোড়ে এসে বসেন মমতা। চা, বিস্কুট, ঘগুনি, রুটি বিক্রি করে তিনি খুশি তিনি। পাড়ার অনেকেই রাতে খাবারের জন্য রুটি কিনে নিয়ে যান। এছাড়া চা-ঘুগনি খেতেও ভিড় করেন অনেকে। এইভাবেই হাসি-খুশী আরও এক নতুন জীবন লড়াই করে চলেছেন বারুইপুরের বয়স পঞ্চাশের মমতা।