যে কোনো বাঙালির ঘরে একটু খুঁজলেই কী পাওয়া যাবে বলুন তো? একটা বাংলা খবরের কাগজ, রবীন্দ্ররচনাবলী এবং..... এবং একটা বোরোলিন। সেই কতো বছর আগে শ্রাবন্তী মজুমদার তার অননুকরণীয় কন্ঠস্বরে যার বিজ্ঞাপনের জিঙ্গল গেয়েছিলেন "সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম বোরোলিন".. যেই সুর ও কথা গত চল্লিশ বছর ধরে বাঙালির মনে গেঁথে আছে।
সময়টা ১৯২৯। সারাদেশ তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠেছে। আমাদের বাংলা চিরকালই ছিল স্বদেশী আন্দোলনের পুরোভাগে। সেই সময় এক বাঙালি যুবক এই স্বদেশী আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করে ফেললেন একটি ওষুধপত্রের কারখানা। যুবকের নাম গৌরমোহন দত্ত। নিজের নামের ও পদবীর আদ্যাক্ষর দুটি দিয়ে নিজের ফ্যাক্টরির নাম রাখলেন 'জি ডি ফার্মাসিউটিক্যালস'। আর এই জি ডি ফার্মাসিউটিক্যালসেই সেই বছরই তৈরি হলো এমন একটি ক্রিম যেটা আজও তিন প্রজন্মের কাছে ভরসার দৃষ্টান্ত .. 'সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম বোরোলিন'।
দূরদর্শী গৌরমোহন বুঝতে পেরেছিলেন যে দেশকে স্বাধীন করার জন্য দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা সবথেকে বেশি প্রয়োজন। ব্রিটিশ শাসন থেকে এই দেশকে মুক্ত করতে হলে তাদের বানিজ্যিক ভাবে পরাজিত করতেই হবে। এই ভাবনা থেকেই তিনি তৈরি করলেন এমন একটি ক্রিম যেই ক্রিম গুনমানে বিদেশী ক্রিমের থেকেও ভালো কিন্তু দাম তার তুলনায় অনেক কম। বছরের পর বছর ধরে যে ক্রিমের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে এমনকি ব্রিটিশ শাসিত ভারতে এই ব্র্যান্ড জাতীয় অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের একটি আইকন হয়ে উঠে। এই মুহূর্তেও যে ক্রিম ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলির মধ্যে একটি।
বোরোলিনের তিনটি প্রধান উপাদান হলো অ্যান্টিসেপটিক বোরিক অ্যাসিড, জিঙ্ক অক্সাইড যা সূর্যের আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি থেকে আমাদের ত্বককে রক্ষা করে এবং অ্যানহাইড্রাস ল্যানোলিন যা ত্বককে আর্দ্র এবং কোমল রাখে। বোরোলিন নামের কাহিনীটা জানেন কি? ল্যাটিন শব্দ "ওলিয়াম" এর অর্থ হলো তেল। বোরিক অ্যাসিড থেকে নেওয়া "বোরো" এবং ওলিয়াম এই দুই মিলিয়ে নাম হয় বোরোলিন। বোরোলিনের লোগো কী জানেন নিশ্চয়ই? বোরোলিনের লোগো হলো একটা হাতি। কেন জানেন? কারণ হাতি হলো শক্তি এবং স্থিরতার প্রতীক। এবং সত্যিই এতো বছর ধরে বোরোলিন তার সুনাম একভাবে রক্ষা করে তার শক্তি এবং সুস্থিরতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। বাজারে বোরোলিনের "মতো" আরো ক্রিম এসেছে কিন্তু বোরোলিনকে কেউই পরাজিত করতে পারে নি। সেই উনিশশো ঊনত্রিশ সাল থেকে বোরোলিন তার জায়গায় অটল হয়ে রয়েছে। আজও উত্তর ভারতের গ্ৰামে গ্ৰামে বোরোলিনের পরিচিতি "হাথিওয়ালা ক্রিম" নামে।
স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বোরোলিন যেন স্বদেশী জিনিসের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আজ যে "মেক ইন ইন্ডিয়া"র এতো প্রচার, আজ থেকে একানব্বই বছর আগে সম্পূর্ণভাবেই "মেড ইন ইন্ডিয়া" প্রোডাক্ট হলো বোরোলিন। উনিশশো সাতচল্লিশ সালে যেদিন ভারত স্বাধীন হয় ঠিক তার আগেরদিন অর্থাৎ চোদ্দোই আগস্ট কলকাতায় একলক্ষেরও বেশি মানুষকে জি ডি ফার্মাসিউটিক্যালসের দুটি আউটলেট থেকে বিতরণ করা হয়েছিলো বোরোলিন। আজও, এই দু হাজার কুড়ি খ্রীষ্টাব্দেও ভারতের অ্যান্টিসেপটিক ক্রিমের মার্কেটের পঁচিশ শতাংশেরও বেশি শেয়ার ধরে রেখেছে বোরোলিন শুধুমাত্র তার গুণমান এবং ব্র্যান্ড পরিচিতির জোরে।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ যখন অ্যাড এজেন্সিতে কাজ করতেন তখন তিনি বোরোলিনের একটা বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিলেন "বঙ্গ জীবনের অঙ্গ".. । সত্যিই আজ বোধহয় বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে বোরোলিন অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে গেছে। বোরোলিন আজ শুধুমাত্র বাংলার নয় ... ভারতেরও গর্ব।