মাতৃভাষার বরাক আন্দোলন

বাংলাই একমাত্র ভাষা যার জন্য দুটি বৃহৎ গণ অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে, 'মোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা'। শুধু বাংলায় কথা বলার অধিকার চাওয়ার জন্য চলে গেল কত প্রাণ যা ইতিহাসে বিরল, ভাষা চাই আমরা নির্বাক নই ঠিকই কিন্তু আমরা আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলতে চাই। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার চাই; কিন্তু আজকের বাংলা জানি না বা বাংলা বলতে পারি না শ্রেণীটি বাঙালি হয়ে বাঙালির লজ্জা। আজ বরাক আন্দোলনের দিন, অসমের বরাক উপত্যকায় যে ভাষার জন্য আন্দোলন হয়েছিল প্রায় ছয় দশক আগে অর্থাৎ সেই বাংলা ভাষার অধিকারের জন্য সংগ্রামের এক অনন্য উপাখ্যান। এক সময় বেঙ্গল প্রভিন্সেরই অংশ ছিল আসাম কিন্তু পরে তা পৃথক রাজ্যে পরিণত হয়, স্বভাবতই আসামে চিরকালই বাংলা ভাষাভাষির মানুষজন ছিলেন বেশ ভাল সংখ্যাতেই। কিন্তু বিদ্বেষ তো ছিলই, ক্রমে ক্রমে তা দাবানলের আকার ধারণ করে। 

বিশেষ করে আসামের শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দিতে বাঙালি এলাকায় এর প্রভাব পড়ে, পঞ্চাশের দশকে আসামে গড়ে ওঠে "বাঙালি খেদাও" আন্দোলন। ১৯৬০ সালের ৩রা মার্চ অসমের তদানিন্দন সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা রাজ্য আইন সভায় অসমিয়া ভাষাকে আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা ঘোষণা করে। যার প্রতিবাদে ১৯৬০ সালের ১৬ই এপ্রিল শিলচরে বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা এক প্রতিবাদী সভার আহ্বান করে। এই সভা থেকেই অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথের নেতৃত্বে সরকার নির্ধারিত ভাষা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য কমিটি হয়। অন্যদিকে, শিলচরে ২রা ও ৩রা জুলাই চপলাকান্তের সভাপতিত্বে "নিখিল আসাম বাঙলা ভাষা সম্মেলন" নামে আরেকটি প্রতিবাদী সভা আয়োজিত হয়।  

মানুষের এই দাবিকে উপেক্ষা করে, কার্যত খারিজ করেই ১৯৬০ সালের ১০ ই অক্টোবর আসামে সর্বত্র সরকারি ভাবে অসমিয়া ভাষা প্রয়োগের জন্য বিধানসভায় ভাষা আইন পাশ হয়। আসামের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ কথ্য ভাষা যা ছিলো আসামে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ বাঙালির মাতৃভাষা সেই বাংলাকে সরকারি ভাষাকে মান্যতাই দেওয়া হলো না। মৌলিক অধিকার পড়ে রইলো সংবিধানের ছাপা অক্ষর হয়েই!

এই কালা ভাষাআইনের প্রতিবাদে রাজমোহন নাথের সভাপতিত্বে ১৮, ১৯ ও ২০ নভেম্বর শিলচরে অনুষ্ঠিত হয় "সংগ্রাম পরিষদ" এর এক বিশাল সম্মেলন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যদি আইন করে বাংলা ভাষাকে অসমিয়া ভাষার সমমর্যাদা দেওয়া না হলে, বাঙালী সমাজের মৌলিক অধিকার ও মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার রক্ষার্থে আসামের বাংলা ভাষা অধ্যুষিত অঞ্চল গুলি বৃহত্তর আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া অপরিহার্য হয়ে পড়বে এবং এক অন্য বাঙালিদের জন্য এক স্বাধীন অসমের আত্মপ্রকাশ আবশ্যক হয়ে পড়বে।

তারপর আসে ১৯ মে, শুরু হয় ভাষার জন্য গণআন্দোলন। উত্তেজিত জনতার প্রতিরোধে সরকারের বাহিনী ট্রেন চালাতে ব্যর্থ হন। ১৯ মে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অংশগ্রহনকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পুলিশ এদের অনেককেই অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়,চলতে থাকে লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস। ভাষা আন্দোলনের প্রথম নারী শহিদ কমলা ভট্টাচার্য, ১৯৬১ সালের আজকের দিনেই মাত্র ষোলো বছর বয়সে প্রান দেন l

দুপুর আড়াইটার সময় রেলস্টেশনের কর্তব্যরত বি এস এফ এর বাহিনীর সদস্যরা হঠাৎ গুলিবর্ষণ করতে শুরু করে গুলিবিদ্ধ হয়ে তৎক্ষনাৎ নিহত হন ৯ জন। তারা হলেন - সুনীল সরকার, সুকমল পুরকায়স্থ, কুমুদ দাস, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, তরনী দেবনাথ, হীতেশ বিশ্বাস, শচীন্দ্র পাল, কমলা ভট্টাচার্য, কানাই নিয়োগী। পরেরদিন স্টেশন পার্শ্বস্থ পুকুর থেকে সত্যেন্দনাথ দেবের দেহ উদ্ধার করা হয়। রাতে হাসপাতালে মারা যান বীরেদ্র সূত্রধর। সর্বমোট ভাষাশহিদদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ জন। ১৯ মে দিনটি ছিল ইতিহাসের এক ন্যাকারজনক ঘটনা ! 

প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে, গ্রেফতার করা হয় আন্দোলনে যুক্ত প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মানুষকে। এতেও দমে যাননি আন্দোলনকারীরা। রক্ত আর আত্মত্যাগের বদলে অবশেষে ওই অঞ্চলে সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১১ জন ভাষা শহীদের রক্তের বিনিময়ে অবশেষে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর নির্দেশে গৃহীত হয় সংশোধনী আইন, কাছাড় জেলায় বাংলাভাষাকে ব্যবহারের অধিকার দেওয়া হয়। আসামে ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে এবং বাংলা ভাষা বিধানসভায় স্বীকৃতি পায়।

বাংলা আমার মায়ের ভাষা, ভালোবাসা ভালোভাষা!  

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...