“বিপদে পড়িলে তাকে ডাক মা বলিয়া।।
দয়ালু মা বনবিবি নিবে উদ্ধারিয়া।”
জল আর জঙ্গলে তাদের বাস। বাঁচতে হয় বাঘ, কুমীর, কামট আর হিংস্র প্রাণীদের সঙ্গে লড়াই করে। তার ওপর আছে ঝড় ঝঞ্ঝা, বান, বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ডাকাত, জলদস্যুর আক্রমণ। দরিদ্র অসহায় মানুষ লড়াই করে টিকে থাকতে এক ঐশ্বরিক ক্ষমতার ওপর নির্ভর করতে চেয়েছিল ভাটির দেশের মানুষরা। সুন্দরবন। দক্ষিণ বঙ্গের এই স্থানটিকে বলা হয় ‘আঠেরো ভাটির দেশ’।
সেই দেশের মানুষরা তারা আঁকড়ে ধরে ‘বনবিবি’কে। দক্ষিণ বঙ্গের সুন্দর বন অঞ্চলের লৌকিক দেবী হলেন ‘বনবিবি’। তিনি সুন্দরবনের জেলে, বাউয়ালি বা কাঠুরে আর মৌয়াল বা মধু সংগ্রহকারীদের রক্ষাকর্ত্রী। আউলে, বাউলে, মোউলে, জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ গভীর বনে প্রবেশের আগে বনবিবিকে শরণ করে। হিন্দু এবং মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষই এই দেবীর পুজো করেন।সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও সম্প্রদায়ের মানুষরাও বনবিবির পুজো করেন।
জগত জননী বনবিবি বনে থাকে।।
বিপদে পড়িলে তুমি ডাকিও তাহাকে।।
লৌকিক ধারণা, বাঘ ও ভূত-প্রেতের মতো অপশক্তির ওপরে কর্তৃত্ব করেন বনবিবি। তাই গভীর বনে কাঠ, গোলপাতা, মধু ও মোম সংগ্রহ বা মাছ ধরতে যাওয়ার আগে বনবিবির উদ্দেশ্যে শিরনি দেন ক্ষীর বা অন্ন উৎসর্গ করা হয়।
প্রতি বছর মাঘ মাসের প্রথমে মূল পুজো হয়।
বনবিবির পুজোর নির্দিষ্ট কোনও নিয়ম নেই। পুরোহিত ছাড়াই পুজো হয়। মানুষ নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী পুজো করে।
"বনবিবি বলে সই শুন দেল দিয়া ।
সকল আঠার ভাটি লহিব বাটিয়া ।।
বনবিবির উৎপত্তি নিয়ে দুটি কাহিনি শোনা যায়। প্রথম কাহিনির গল্প অনেকটা এরকম। এক সওদাগরের দুই সুন্দরী স্ত্রী ছিলেন। ছোটো বউয়ের চক্রান্তে সন্তানসম্ভবা বড়ো বউ গুলালবিবি সুন্দরবনে নির্বাসিতা হন। কয়েকদিন পর বনের মধ্যেই যমজ পুত্র-কন্যার জন্ম দিয়ে তার মৃত্যু হয়। সদ্যোজাত শিশু দু'টির কান্না শুনে বনের বাঘ, কুমির, হরিণ, অজগর, বানস সবাই ছুটে আসে। তারাই দুই ভাইবোনকে লালনপালন করে বড়ো করে তোলে। ছেলেটি বড়ো হয়ে বাঘের রাজা দক্ষিণ রায় এবং মেয়েটি বনবিবি নামে পরিচিত হয়।
দ্বিতীয় কাহিনী অনুযায়ী, মক্কার ফকির নিঃসন্তান ইব্রাহিম সন্তান লাভের আশায় দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন । দ্বিতীয় পত্নী গোলালবিবি সন্তানসম্ভবা হলে ইব্রাহিম তাকে বনের মধ্যে নির্বাসন দেন। প্রথম স্ত্রীর প্ররোচনায় । গোলালবিবি যমজ সন্তানের জন্ম দেন। ছেলে এবং মেয়ে। তাঁদের নাম হয় বনবিবি ও শাহ জঙ্গলী। সাত বছর পর ইব্রাহিম ভুল বুঝতে পেরে স্ত্রী সন্তানদের মক্কায় ফিরিয়ে আনেন । একদিন নামাজ পড়ার সময় দুই ভাইবোন অজান্তে দুটি যাদু টুপি মাথায় দিতেই তারা পৌঁছে যায় আঠারো ভাটির দেশে । তো জঙ্গলে ভাই বোনের নামাজের সুর কানে যেতেই দক্ষিণ রায় রেগে গেলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন যুদ্ধ করবেন । কিন্তু দক্ষিণের মা রায়মনি বলেন, পুরুষ হয়ে নারীর সঙ্গে যুদ্ধ করা মানায় না। পরে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। দুজনে ভাগ করে নিলেন সুন্দরবনকে । বনবিবি পেলেন ভাটির দেশের মানুষ , আর দক্ষিণ রায় পেলেন অরণ্যের আধিপত্য।
বহু বছর আগে সুন্দরবনের এক গ্রামে বাস করত এক গরিব বিধবা। দুখে নামে তার এক ছেলে ছিল। দুখে’কে সুন্দরবনে চাক ভাঙতে নিয়ে যায় তার কাকা, ধনা আর মনা।
ছেলেকে বনে ছাড়তে নারাজ দুখের মা দুখেকে বলে, “বনে আমার মতো তোর আর এক মা আছেন। যখন কোনও বিপদে পড়বি তাঁকে ডাকবি। তিনি তোকে রক্ষা করবেন”।সুন্দরবনে সে সময় বাস করতেন গাজী নামে এক আউলিয়া। জঙ্গলে বাঘরূপী দক্ষিণ রায় বা রায়মনি। অরণ্যের অধিকার ছিল তার দখলে।
দুখুর ওপর নজর পড়ল তার। রাতে ধনা-মনাকে স্বপ্ন দিয়ে বলল, ‘দুখেকে তার কাছে ছেড়ে জেতে।বদলে সপ্তডিঙা ধন দেবে তাকে।’ সম্পদের লোভে ধনা-মনা দুখেকে বনের মধ্যে ছেড়ে ডিঙা ভাসিয়ে দেয় নদীতে।
গহীন বনে অসহায় দুখুর হঠাৎ মনে পড়ে তার মায়ের কথা। সে শরণ নেয় তার আরেক মায়ের। তাকে দক্ষিণ রায়ের হাত থেকে রক্ষা করে বনবিবি।
বনবিবিকে নিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি ধনা-দুখে কাহিনি।
বনবিবি-র ‘জহুরনামা’ পুঁথির কাহিনীকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে যাত্রাপালা, পালাগান, কথকতা পাঠ করা হয়। বনবিবি পালাগানে হিন্দু এবং ইসলাম দুইধর্মের অনুসঙ্গ মেলে।
বনবিবির দু'রকম মুর্তি দেখা যায়। একটি মূর্তিতে দেখা যায় বিবির মাথায় টুপি, চুল বিনুনি করা, কপালে টিকলি, গলায় হার, পরনে পাজামা, পায়ে জুতো, কোলে একটি বালক।কোথাও বাঘের পিঠে, আবার কোথাও মুরগির পিঠে। ভক্তজনের বিশ্বাস কোলের ছেলেটি সেই দুখে।
অন্য একটি মূর্তিতে দেখা যায়, মাথায় মুকুট, গলায় হার ও বনফুলের মালা, সর্বাঙ্গে নানা অলংকার এবং কোলে বা পাশে দুখে।
হিন্দু চিত্রগুলিতে তিনি হরিদ্রা, মুকুট এবং গলায় হার, বনফুলের মালা পরা পাওয়া যায়।তিনি একটি লাঠি এবং ত্রিশূল বহন করেন। তিনি তার মুসলিম অনুসারীদের দ্বারা বনবিবি হিসাবে পূজিত হন এবং তাদের কাছে পীরানী হিসাবে পরিচিত। তার মুসলিম চিত্রগুলিতে প্রধানত মুষ্টিমেয় মূর্তিগুলি টিকলির সাথে একটি টুপি পরেন, চুল বিনুনি করা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্রদের রক্ষার জন্য মা বনবিবি যে লাঠি ব্যবহার করেন তার নাম ‘আশাবাড়ী’।
প্রতি বছর মাঘ মাসের প্রথম দিনে মহা সমারোহে এই পুজো অনুষ্ঠিত হয় ।
সুন্দরবনের লৌকিক বিশ্বাস বনবিবিকে পুজো না করে বনে গেলে বিপদ আসবেই। মধুর মরসুম শুরু হলে প্রথম চাক ভাঙার পর সেই মধু বনবিবিকে নিবেদন করা হয়। কেউ যদি দুপুর ১২ টা থেকে ২ মধ্যে বনে ঢুকলে দেবী রুষ্ট হন। ওই সময় বনবিবি শুক্রবারের নমাজে থাকেন।
সুন্দর বনের গ্রামগুলিতে পুরুষ সদস্যরা যখন জঙ্গলে যান মধু সংগ্রহের জন্য তখন বাড়ির বিবাহিতা মহিলারা শাঁখা, সিঁদুর এর মতো বৈবাহিক চিহ্ন ধারণ থেকে বিরত থাকেন। তারা ফিরে এলে তেল-হলুদ দিয়ে স্নান করে আবার মহিলা আবার বৈবাহিক চিহ্ন ধারণ করেন। লৌকিক বিশ্বাস, কেবলমাত্র লোভী আর ধনী রাই বনবিবির কোপে পড়ে।
দ্বীপবাসী মানুষদের প্রকৃতির সঙ্গে নিত্য সহযোগ। উপায় নেই সেখান থেকে অন্য জীবন বেছে নেওয়ার। কাঠ, মিন, মধু বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের। সহজ জীবনের সরল বিশ্বাসে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অন্ধের যষ্টির মত লৌকিক দেবদেবীদের থানে আশ্রয় নেয় তারা। অনিশ্চয়তায় ভরা জীবনে সেই তাদের বেঁচে থাকার আশ্বাস। তার গায়ে কোনও বিভেদের গন্ধ নেই।