বলিউডের ‘কলকাতা’

ঝাপসা কুয়াশায় ঘণ্টি বাজিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে ভোরবেলার প্রথম ট্রাম। মন্দির চত্বর জুড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পায়রা। হাওড়া ব্রিজ ছুঁয়ে সোনালী সূর্যটা সবে দেখা দিতে শুরু করেছে। লালইঁটের বাড়িগুলো পার হয়ে বড়বাজারে হাঁকডাক শুরু হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। কচুরি শিঙাড়ার গন্ধটা নাকে এলে স্থির থাকা যায় না। ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে শহর। চেনা গন্ধে শহর চিনে নিচ্ছে ঘরে ফেরার দল। এ গন্ধ প্রিয় শহরের। এ গন্ধ কলকাতার। স্বাদে-গন্ধে-বর্ণে এ এক ভীষণ রঙিন ক্যানভাস।

কলকাতাকে এভাবেই চেনে বাকি দুনিয়া। মিছিলের শহর। সংস্কৃতির রাজধানী।

টক-ঝাল-নোনতা-মিঠের ভারী রঙিন এক শহর। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেলে আশ্চর্য তার আবেদন। ব্রিটিশ রাজশক্তি যত্নে গড়ে তুলেছিল তিলোত্তমাকে। ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর ভবন আর বাড়ি-ঘরে শহর ভরেনি তারা সঙ্গে ছিল যথাযথ পরিকল্পনা। তাতে অবশ্য মোটেই কোণঠাসা হয়নি বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি ও যাপনের ধারাটি, বরং বহু সংস্কৃতির রং মেখে কলকাতা হয়ে উঠেছিল আরও মোহময়ী।

কলকাতার সেই রূপ বারবার ধরা পড়েছে ছবিতে সিনেমায়। বলিউড পেরিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও। কখনও ছবির প্রেক্ষাপ্ট হয়ে উঠেছে কলকাতা আবার কখনও শুধুই লোকেশন। এই ট্র্যাডিশন আজকের নয়। বহুদিনের। একসময় ভারতীয় সিনেমার প্রাণকেন্দ্র ছিল কলকাতা। সেই ছবি আজ বদলে গেলেও কলাকাতার টান কমেনি। কলকাতায় বলিউড বললে প্রথমেই মনে পড়ে যায় বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিনে’র কথা। তারপরই অশোক কুমারের হাওড়া ব্রিজ। পরিনীতা থেকে বরফি কিংবা পিকু একের পর এক নাম আসবে। এই লিস্টে আছে দক্ষিণী ছবিও। ১৯৯১তে এজে অরবিন্দনের পরিচালনায় ‘বাস্তুহারা’ ছবির শুটিং হয়েছিল কলাকাতা। কলকাতা, রানাঘাট ধরা দিয়েছিল এই বিখ্যাত মালায়ালম ছবিতে। অধুনা জনপ্রিয় দক্ষিণী অভিনেত্রী সাই পল্লবীর অভিনীত ‘পদি পদি লেচে মানাসু’র শুটিং হয়েছিল কলকাতায়। ট্রামলাইন আর ব্যস্ত কলকাতা মন কেড়েছিল দক্ষিণের।

তবে কিছু ছবিতে কলকাতা একটু ‘স্পেশাল’। সে সব ছবি দেখার সময় দর্শকরা বারবার প্রেমে পড়েছিল গঙ্গাতীরের এই শহরের। সেই ছবিগুলির তথ্য রইল নিবন্ধে

 

 

কাহানি- ‘দিল কা বাজার হ্যায়, কলকাতা দেখো তো বাকি দুনিয়া বেকার হ্যায়’। কাহানি ছবির এই গান যেন ঠিক করে দিয়েছিল গোটা ছবির মুড। বাকি দুনিয়া ‘কাহানি’ দেখেছিল কিন্তু কলকাতা দেখেছিল ‘কাহানির’ কলকাতাকে। বিদ্যা বালান অভিনীত সুজয় ঘোষের এই থ্রিলারে সেরা কলকাতা ধরা পড়েছিল যেন। একেবারে অন্যরকম। ছবির শুটিং হয়েছিল উত্তর থেকে দক্ষিণে। উত্তর কলকাতার অলিগলি,  কুমোরটুলি, নোয়াপাড়া ট্রাম ডিপো, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, হাওড়া ব্রিজ, বিদ্যাসাগর সেতু, কালীঘাট কোথায় নয়! শরৎ বোস রোডের মোনালিসা গেস্ট হাউসকে কেন্দ্র করে ঘুরেছিল কাহিনি। ছবিতে বিদ্যা বালান এই লজেই ছিলেন। তারপর থেকেই রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘মোনালিসা গেস্ট হাউস’র ১৫ নম্বর রুম।  

kahani

 বরফি- শুধু কলকাতা নয়, দার্জিলিং থেকে ঘুম জুড়ে হয়েছিল অনুরাগ বসুর ‘বরফি’ ছবির শুটিং। ছবির মুখ্য অভিনেতা রণবীর কাপুরকে মাঝে মাঝেই দেখা যেত উত্তরের দরজি পাড়ায় সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। এসপ্ল্যানেড, ফুলঘাট, ট্রামের দৃশ্যে সত্তর দশকের কলকাতা। রণবীর কাপুর আর প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার দুরন্ত অভিনয়ে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল মানবিক ছবি বরফি।

barfi

পিকু- ২০১৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল সুজিত সরকারের ছবি ‘পিকু’। অমিতাভ বচ্চন, ইরফান খান, দীপিকা পাডুকন অভিনীত পিকু আজও কলকাতা আর বাঙালির আবেগ। প্রবাসী বাঙালি প্রবীণ ভাস্কর ব্যানার্জী আর তাঁর কন্যা পিকুর গল্প। দীর্ঘদিন প্রবাসে কাটানোর পর জীবনের প্রান্তে পৌঁছে সেই প্রবীণের ইচ্ছে হয় ঘরে ফেরার। কলকাতায়। লাল ইঁটের বাড়ি। সবুজ কাঠের জানলা। গলি পথ ঘাট আর সকালের কলকাতায় ছবি জুড়ে ঘরে ফেরার মনকেমন। শুটিং হয়েছিল ঐতিহ্যবাহী লাহাবাড়ি, হাওড়া ব্রিজ, ট্রাম ডিপো আর উত্তর কলকাতার বিভিন্ন অংশে।   

piku

যুবা- ২০১৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল মণিরত্নমের রাজনৈতিক থ্রিলার ‘যুবা’। রানী মুখোপাধ্যায়, করিনা কাপুর, অভিষেক বচ্চন, অজয় দেবগণের মাল্টি স্টার মুভি। ছবির অনেকখানি জুড়ে ছিল হাওড়া ব্রিজ। হাওড়া ব্রিজ বাংলার প্রতিবাদ প্রতিরোধের চিহ্ন। দেশ জুড়ে আলোড়ন ফেলেছিল মণিরত্নমের এই ছবি।

     

লাভ আজকাল- দুই প্রজন্মের ভালোবাসার ছবি লাভ আজকাল। মুখ্য চরিত্রে সইফ আলি খান আর দীপিকা পাড়ুকন। সান ফ্রান্সিসকোর পটভূমিতে ছবি। ফ্ল্যাশব্যাকে কলকাতা। হাওড়া ব্রিজ আর পুরনো কলকাতার দৃশ্য দেখা গিয়েছিল ছবিতে। পরিচালনায় ইমতিয়াজ আলি। 

 

গুন্ডে- আলি আব্বাস জাফরের পরিচালনায় রণবীর সিং আর অর্জুন কাপুর, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া অভিনীত ক্রাইম থ্রিলার গুন্ডে। ছবির লোকেশন বেশির ভাগটাই ছিল কলকাতায়। ব্র্যাবর্ণ রোড, হাওড়া ব্রিজ দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির, কলকাতা হাইকোর্ট চত্বরে শুটিং হয়েছিল। দারুণ জনপ্রিয় হয় ছবির গান। 

gunde

ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সি- ধুতি পরা, পাতা কাটা চুলের ব্যোমক্যেশ বক্সি সুশান্ত সিং রাজপুতকে আজও বাঙালি বেশে বারবার মনে করে বলিউড। শুধু বলিউড কেন বলা যায় গোটা দেশের সিনেমাপ্রেমিদের কাছেই বাঙালি গোয়েন্দা হিসেবে দারুণ আবেদনময় সুশান্ত। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে ২০১৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সি’। বিবাদি বাগ, কলেজ স্ট্রিট,  আগরপাড়া, বো ব্যারাক, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রায় গোটা মধ্য উত্তর কল্কাতা জুড়ে শুটিং হয়েছিল। এই ছবি ছিল পরিচালক দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক ড্রিম প্রোজেক্ট। ১৮৭৮ সালের কলকাতাকে তুলে ধরা হয়েছিল। পোশাক আশাক থেকে শুরু করে পথ ঘাট, যানবাহন সব যেন আঠারো শতকের ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা। ২০১৪ সালের পথঘাটকে ১৯৪৩ স্লাএ বদলাতে লাগাতার ১৮ ঘণ্টা সময় লেগেছিল।  

 

বুলেট রাজা- ২০১৩ সালে মুক্তি পায় তিংমাংশু ধুলিয়ার ছবি বুলেট রাজা। প্রধান ভূমিকায় সইফ আলি খান আর সোনাক্ষী সিনহা। শুটিং হয়েছিল হেদুয়ার লাহাবাড়িতে। উত্তর কলকাতার গলি তস্য গলি, কুমোরটুলি, প্রিন্সেপ ঘাট, দক্ষিণ কলকাতায় হয়েছিল শুটিং।

bullet raja

পরিনীতা- ২০০৫ সালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পরিনীতা’ উপন্যাসের কাহিনিকে ছবিতে রূপ দিয়েছিলেন পরিচালক প্রদীপ সরকার। পুরনো কলকাতার প্রেক্ষাপটে ছবি। ছবির কেন্দ্রে বিদ্যা বালান এবং সইফ আলি খান। তাঁরাও বাঙালি। হাওড়া ব্রিজ, প্রিন্সেপ ঘাট, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, বেলগাছিয়া রাজবাড়ি, বালি রাজবাড়ি, সেন্ট জনস চার্চে শুটিং হয়েছিল। পার্ক স্ট্রিটের ম্যুলা রোঁজ আলাদা গ্ল্যামারে ধরা দেয়। 

 

লুটেরা- বিক্রমাদিত্য মোতানের অন্যধারার প্রেমের ছবি ‘লুটেরা’। মুক্তি পেয়েছিল ২০১৩ সালে। সোনাক্ষী সিনহা, রণবীর কাপুর অভিনীত এই ছবির শুটিং হয়েছিল ইটাচুনা রাজবাড়িতে। কলকাতা আর পুরুলিয়া মিলিয়ে হয়েছিল শুটিং। হিন্দি হোক বা বাংলা আর কোনও ছবিতে এমন অসাধারণ রূপে আগে কখনও দেখা যায়নি পুরুলিয়াকে। ‘লুটেরা’ ছবিতে পুরুলিয়া ছিল যেন এক অন্য আবিষ্কার।

 

তথ্য সূত্র- হিন্দুস্তান টাইমস (২৬ মার্চ, ২০১২)

ভোগ  

টাইমস অফ ইন্ডিয়া

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...