শরীর লজ্জার, না গর্বের?
বডি শেমিং । জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে যার শিকার পৃথিবীর প্রায় সব মানুষ।সেখানে ধর্ম-বর্ণ এর নেই বাঁধা।
‘ আর কত খাবি দিন দিন তো ... ‘। ‘ এই চেহারায় শাড়ি, কাঠির সঙ্গে ... ‘। ‘ কোনও ভালো মেয়ে এভাবে হাসে ‘ বা ‘ হিজড়াদের মতো হাঁটো কেন ‘।
প্রায় সকলেই চলতে ফিরতে গুড মর্নিং বা গুড নাইটের মতো এইসকল বুলি’ও কানে তোলেন।
স্থূলস্কায়া জেনিফার উইলসন। শপিং মলে কেনাকাটা করার সময় ট্রলি নিয়ে আছাড় খেয়ে পড়লেন। মুহূর্তের মধ্যে বন্দী হলেন মুঠোফোনে। ভাইরাল হলেন গোটা পৃথিবীর কাছে। এক কথায় হাসির খোরাক হলেন।
অস্ট্রেলিয়ার কোয়াডেন বেলেস। নয় বছরের বাচ্ছা। দিতে চেয়েছে আত্মাহুতি। কারণ? তাঁর খাটো উচ্চতা। হাসির খোরাক সেও।
এভাবেই চলতে থাকে তালিকা। আপামর মানুষের সস্তার বিনোদনে পুষ্টি যোগাতে থাকে সাধারণ মানুষের অক্ষমতা।এমনকি তারকারাও বাদ পড়েননা সেই তালিকা থেকে।
লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও থেকে শুরু করে ভারতের পিগি চপ্স। কে নেই সেই তালিকায়!
সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে শুধুমাত্র ২০১৬ সালেই আমেরিকাতে প্রায় ৪২ লক্ষ মানুষ প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছেন চেহারা বদলাতে।
১৮ বছরের কম বয়সী অনেকেই স্বেচ্ছায় নিজেদের কাটাছেঁড়ার মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। ভিয়েতনামে অনেক মা মেয়ের জন্মদিনে উপহার হিসেবে প্লাস্টিক সার্জারি করাচ্ছেন!
একনাগাড়ে মানুষের মুখ থেকে এমন টিপ্পনী শুনতে শুনতে বিতৃষ্ণা জায়গা করে মনে। কেউ কেউ নেশায় বুঁদ হতে বাধ্য হচ্ছে নিজের শরীর ভুলতে। আসলে অন্য এক ব্যাধির মতো এও এক মহামারির আকার নিয়েছে।মনে মনে তার বাস।
সৌন্দর্যের কোনও স্ট্যান্ডার্ড থাকতে পারে না। সৌন্দর্যের কোনও সংজ্ঞাহীন।
নিক ভুজিসিক। শারীরিক প্রতিবন্ধী। একজন মোটিভেশনাল স্পিকার ও লেখক। জন্ম অস্ট্রেলিয়ায়। নিকের জন্ম হয় হাত ও পা ছাড়াই। জন্মগত রোগ যার নাম Tetra-amelia syndrome । মাত্র দশ বছর বয়সেই নিক একবার আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়।
কেউ যখন শারীরিক কোনও বিষয় নিয়ে তির্যক মন্তব্যের শিকার হয়, সে এক পা এক পা করে খাদের দিকে এগিয়ে যায়। খাদের এপারে জীবন, ওপারে আত্মহত্যা। বলেছিলেন নিক।
সময় যত এগোচ্ছে, আধুনিকতার মরিচীকা যত চোখ টানছে; মনুষ্যত্ব ততই নীরব শয়তানে পরিবর্তন করছে নিজেকে।শরীর মনের উপর জোর খাটাচ্ছে।সকলের অজান্তেই সকলের মধ্যে শরীর আর মনের জেহাদ ঘটে চলেছে। অথচ এই দুই নিয়েই তো মানুষ!
এই মানসিক বিক্রিতির আমদানি কত্থেকে ?তবে তথ্যের ঝুলি একটু নেড়েচেড়ে দেখা যাক। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো। ‘ম্যাডনেস অ্যান্ড সিভিলাইজেশন’-এ বলেছিলেন মধ্যযুগেও ইওরোপে মানসিক প্রতিবন্ধীদের সামাজিক স্বীকৃতি ছিল।আঠারো শতকের নবজাগরণের নতুন সূর্য মানুষের চিন্তালোকে নতুন আনকোরা মেঘ ঘনিয়ে এনেছে।
ভারতে বডি শেমিং যুক্তিবাদেরই ফসল। উনিশ শতকে আকারে ছোট মানুষদের স্থান হতে শুরু করে সার্কাসে। যা মূলত এক পশ্চিমি আধুনিক প্রদর্শন। কৌতুকের উপাদান হিসেবে।
বডি শেমিং’ শব্দটি সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণেই মুখে মুখে ফেরে। আজও মোটা চেহারার কিশোরী বা একটু খাটো, মাথায় কম চুল ছেলেটি ভিতর ভিতর ডুকরে অথে।হইচই এর শিকার হয়ে তাদের কান্না বুকেই মৃত্যু বরণ করছে।
যদিও জনপ্রিয় সংস্কৃতি বর্তমানে প্রতিবাদে মুখর। বলিউডের মেন স্ট্রিম থেকেই উঠে এসেছে এমন কিছু ছবির উদাহরণ যা প্রশংসনীয়। আন্তর্জাতিক বহু মঞ্চে তারকারাও সরব, প্রতিবাদে মুখর।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেই তারা হাতিয়ার করে ধেয়ে এসেছে বডি শেমিং রুখতে। কিছু মানুষ আনন্দের মুখোশ পরে নিজেদের দুঃখ লুকোতে; কিছু মানুষ দুঃখের মুখোশ পরে অন্যদের দুঃখ দিতে।
তবুও কোয়াডেন, জেনিফাররা মুখ লুকোয়। পালাতে চায়। বহু দূরে সূর্য ডুবছে। এই পরন্ত বিকেল যেন মানবজাতির মননে নতুন সূর্যোদয় ডেকে আনে।
বড় প্রাসঙ্গিক অর্থেই গাইতে ইচ্ছে হয়,- ‘ আর কতটা পথ পেরলে তবে মানুষ হওয়া যায়...!’