‘পায়ে পড়ি বাঘমামা
কোরো নাকো রাগমামা
তুমি যে এ ঘরে কে তা জানতো?’- মনে পড়ে এই গানটা? সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রের বিখ্যাত গান। তবে এই মুহূর্তে উক্ত লাইনগুলোর সঙ্গে বেশ খানিকটা তফাৎ আছে। প্রসঙ্গে ফিরে সবিস্তারে বললে বলতে হয়, প্রথম তফাৎ, বাঘমামা ঘরে চার দেওয়ালের মধ্যে নয়, বক্সারের জঙ্গলে। গায়ে হলদে ডোরা কাটা দাগ নয়, বাঘমামা একেবারে তেল কুচকুচে কালো। যাকে আমরা ব্ল্যাক প্যান্থার বলেই চিনি বা জানি। আর বাকি রইল, তার উপস্থিতি টের পাওয়া না পাওয়া, সেক্ষেত্রে কিছুটা মিলও আছে, আবার অমিলও আছে অবশ্য। মিল হল, আগে থেকে গুপী-বাঘা যেমন টের পাননি, ঠিক তেমনই ফরেস্ট গাইড লেখু মাহাতোও ভাবতে পারেননি এতো কাছ থেকে ব্ল্যাক প্যান্থারের দেখা পাবেন। আর অমিল হল, গুপী-বাঘা ঘরে বাঘ থাকতে পারে, এ আন্দাজ তাঁদের ধারণাতে না এলেও, লেখু মাহাতো কিন্তু জানতেন যে, বক্সারের জঙ্গলে তেল কুচকুচে কালো বাঘমামার উপস্থিতি আছ, তবে জানলেও, দেখা পাওয়ার আশা করেননি। কিন্তু পেলেন। এক প্রকার সৌভাগ্য বটে।
বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গলে ডোরাকাটাদের দেখা না মিললেও এবার ফরেস্ট গাইডের ক্যামেরায় ধরা দিল একটা নয়, একেবারে জোড়া 'মেলানেস্টিক লেপার্ড' বা ব্ল্যাকপ্যান্থার। আদতে ওই বন্যপ্রাণীরা লেপার্ড গোত্রীয়। তবে জিন ঘটিত কারণে ওই ব্ল্যাকপ্যান্থারদের গায়ে হলদে ছোপ ফুটে ওঠে না। নিজেদের ভয়ঙ্কর চেহারার জন্য সাধারণত দিনের বেলা ব্ল্যাকপ্যান্থারদের দেখা মেলা প্রায় বিরলতম ঘটনা বললেও ভুল হবে না। গত মঙ্গলবার একদল পর্যটককে নিয়ে বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের জয়ন্তী থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরের মহাকাল পাহাড় থেকে ফিরছিলেন ফরেস্ট গাইড লেখু মাহাতো। আচমকাই তিনি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এক জোড়া ব্ল্যাকপ্যান্থারকে নেমে আসতে দেখেন।
বন দপ্তরের দাবি, ওই ছবি থেকেই পরিষ্কার যে, বক্সা পাহাড়ের জনমানবহীন দুর্গম এলাকায় ব্ল্যাকপ্যান্থারদের বসতি রয়েছে। এর আগে অবশ্য বেশ কয়েকবার বন দপ্তরের পাতা ক্যামেরার ট্র্যাপে ব্ল্যাকপ্যান্থারের অস্পষ্ট ছবি ধরা পড়েছে।
এদের সারা শরীর মিশমিশে কালো। জ্বলজ্বল করে ওঠে গাঢ় হলদে-সোনালী চোখ। দেখতে এতটাই ভয়ানক যে স্বাভাবিক 'মেলানেস্টিক লেপার্ড'দের থেকে অনেক বেশি হিংস্র মনে হয়। বন দপ্তরের নথি বলছে- উত্তরবঙ্গের পাঁচটি সংরক্ষিত জঙ্গল মহানন্দা অভয়ারণ্য, নেওড়াভ্যালি, গরুমারা ও জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান এবং বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গলে ব্ল্যাকপ্যান্থারদের অস্তিত্ব রয়েছে। তবে এবারের ঘটনায় বনকর্তারাও বেশ উচ্ছ্বসিত। সাধারণত বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের মহাকাল পাহাড় এলাকাটি দুর্গম এবং জনমানব শূন্য। ওই এলাকাতেই বেশ কয়েক বছর ধরে নিয়মিত ভাবে ক্লাউডেড লেপার্ড ও এশিয়াটিক ব্ল্যাক বিয়ারের দেখা পাওয়া যাচ্ছিল। এবার সেই তালিকায় নয়া সংযোজন হল ব্ল্যাকপ্যান্থার। এই ঘটনার পর ওই স্পর্শকাতর এলাকায় কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করেছে বন দপ্তর। বিশেষ করে চোরাশিকারীদের আটকানোর জন্য।
বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের ক্ষেত্র অধিকর্তা শুভঙ্কর সেনগুপ্ত বলেন, বক্সার পাহাড়ি অঞ্চলে ব্ল্যাকপ্যান্থাররা তীব্র শীতের কারণে বছরের ঠিক এই সময়টায় শিকারের সন্ধানে নিচে নেমে আসে। তবে দিনের বেলায় এদের দেখা পাওয়াটা সত্যিই দুষ্কর। এর থেকে প্রমাণিত হয় বক্সার জীব বৈচিত্র্য এখনও অটুট।
যাইহোক সবথেকে ভালো কথা হল, এবার থেকে বক্সা পাহাড় ঘুরতে যাওয়ার একটা বাড়তি আকর্ষণ তৈরি হল। আর তা হল, এই তেল কুচকুচে কালো বাঘমামাদের দর্শন করে চক্ষু এবং মন সার্থক করা।