'মুলেন ব্যাপকং ন্যাসং ধ্যায়েদেবীং পরাং শিবাম।
ধ্যায়েদেবীং বিশালাক্ষীং তপ্তজাম্বুনদপ্রভাম।।
দ্বিভুজাম্বিকাং চণ্ডীং খড়গখেটকধারিণীম।
নানালংকারসুভগাং রক্তাম্বরধরাং শুভাম।।
সদা ষোড়শবর্ষীয়াং।
প্রসন্নাস্যাং ত্রিলোচনাম মুণ্ডমালাবলি রম্য পীনোন্নতপয়োধরাম শবোপরী মহাদেবীং জটামুকুটমণ্ডিতাম শত্রুক্ষয়করাং দেবীং সাধকভিস্টদায়িকম সর্বসৌভাগ্যজননী মহাসম্পদপ্রদং স্মরেৎ।।'
এটি মা বিশালাক্ষীর ধ্যানমন্ত্র। আদপে বিশালাক্ষী হলেন পার্বতী বা গৌরীর আর একটি রূপ। জগৎ বিখ্যাত বিশালাক্ষী মন্দিরটি বারাণসীর মণিকর্ণিকার শ্মশান ঘাটে অবস্থিত। এখানে সতীর কানের দুল পড়েছিল বলে জানা যায়। বাংলার লৌকিক দেবী তিনি। বাংলার একাধিক অঞ্চলেও দেবী বিশালাক্ষীর মন্দির দেখা যায়। বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়ার রয়েছে বিশালাক্ষী বা বাশুলি দেবীর মন্দির। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস ছিলেন এই মন্দিরের পৌরহিত্যের দায়িত্বে। বাংলার কৃষিজীবী, জলজীবী ও বনজীবী লোকসমাজে বিশালাক্ষীর প্রভাব অসীম। কৃষক, জেলে, মৌয়ালি-বাওয়ালি প্রভৃতি পেশার মানুষের দেবীর পুজো করেন। কথিত আছে, বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রে সতীর দেহ খণ্ডিত হওয়ার সময়, দেবীর কর্ণ ও কুণ্ডল যে স্থানে পতিত হয়েছিল। আদি শঙ্কর সেই পীঠস্থানকে অষ্টাদশ মহাশক্তিপীঠের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সেই থেকেই দেবী মণিকর্ণিকা নামে পরিচিত। তবে কেউ কেউ একে শক্তি পীঠ মনে করেন না। তাদের বক্তব্য, কর্ণকুণ্ডল অলঙ্কার, তা দেহের অঙ্গ নয়। তাই মন্দিরকে শক্তিপীঠ না বলে উপপীঠ বলেন তারা। অন্য মতে, এই মন্দির শক্তিপীঠ। কারণ এখানে দেবীর ত্রিনয়নের মধ্যে একটি নয়ন পতিত হয়েছিল। দেবীর দিব্যচক্ষু সমগ্র বিশ্বকে দেখতে পায়, তাই দেবীর নাম এখানে বিশালাক্ষী। এই পীঠের শিব কালভৈরব নামে পরিচিত।
নানুরে রয়েছে চণ্ডীদাসের বিশালাক্ষী মন্দির। গত তিনশো বছর ধরে সেখানে মহাসমারোহে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। ভট্টাচার্য পরিবারের বিশালাক্ষী মন্দিরের দুর্গাপুজো খুবই বিখ্যাত। সপ্তমীর সকালে শুয়োর বলি দিয়ে এখানে পুজো শুরু হয়। জলঘড়ি দেখে মহাষ্টমীতে সন্ধিপুজোর বলিদান হয়। জনশ্রুতি রয়েছে, ছশো বছর আগে কবি চণ্ডীদাস নানুরে বাসুলি মায়ের করতেন। পরবর্তীতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সেই মন্দির সংলগ্ন ধ্বংস হয়ে যায়। তারপর আজ থেকে তিনশো বছর আগে নানুরের কাছেই শাকুলিপুর গ্রামের কোনও এক তেলি সম্প্রদায়ের গৃহবধূকে বাসুলি মা স্বপ্নাদেশে নিজের অবস্থানের কথা জানান। একথা পরিবার ও স্থানীয়দের জানানোর পরপরই ওই গৃহবধূর মৃত্যু হয়। এরপর ওই গৃহবধূর কথা মতো মাটি খনন করে বাসুলি দেবীর মূর্তি উদ্ধার করা হয়। মহালয়ার আগে নবমী তিথিতে বাসুলি দেবী প্রথম পূজিত হন বলে, তখন থেকে নবমীর দিনই বোধন হয়ে আসছে এই পুজোর। পরবর্তীতে বিশালাক্ষী মন্দিরসহ মোট ১৪টি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। মন্দির প্রাঙ্গণে মোট ১৫টি শিবলিঙ্গ রয়েছে। সারাবছর বিশালাক্ষী ও শিবমন্দিরে নিত্য পুজো হলেও, দুর্গাপুজো হয় মহাসমারোহে। স্থানীয় এলাকায় শাসন পুজো হিসেবে প্রচলিত এই পুজো। সপ্তমীর সকালে কলাবউ ও দোলা নিয়ে উত্তর দিক থেকে অন্যান্য পুজো কমিটি সমবেত হয় বিশালাক্ষী মন্দিরে। এরপর নানুরের দক্ষিণ দিকের একটি পুকুরে শোভাযাত্রা সহকারে ঘট ভরতে যাওয়া হয়। ফেরার পথে শুয়োর বলিদান করা হয়। কথিত আছে, বর্গিদের অত্যাচার ঠেকাতে বাসুলি দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই বলিদান শুরু হয়। প্রাচীনকালের জলঘড়ির দণ্ড মেপে সময় নির্ধারণ করে বিশালাক্ষী মন্দিরে এখনও মহাষ্টমীর সন্ধিপুজোর বলিদান হয়। বলিদান হয় নিঃশব্দে, বলিদান হওয়ার পর ঢাক-ঢোল বাজানো শুরু হয়। প্রাচীনকালের সমস্ত রীতিই আজও মেনে চলা হচ্ছে এখানে।
আবার বর্ধমানের দাঁইহাটের চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পুজোয় ভিন্ন রীতি দেখা যায়। দেবী এখানে মৃন্ময়ী নন, দেবী প্রতিমাটি দারু নির্মিত। তিনি দশভূজাও নন, তিনি দ্বিভুজা। দেবীর সঙ্গে নিত্য পূজিতা হন গৃহদেবতা রঘুনাথ, গুপীনাথ ও জগন্নাথ। সাধারণ অন্নভোগের পাশাপাশি দশমীতে পান্তা ভাত ও পোড়া ল্যাটা মাছ ভোগ দেওয়া হয় দেবী বিশালাক্ষীকে। বিশালাক্ষী পুজো উপলক্ষ্যে ঢাক বাজিয়ে গঙ্গায় ঘট ভরতে যাওয়া হয়। অষ্টমীতে কুমারী পুজোর চল রয়েছে। শাক্ত মতে পুজোর পর বলির প্রথা রয়েছে। অন্নভোগের পাশাপাশি দশমীতে পান্তা ভাত, শাক, শুক্তো, আনাজ ও চাটনির সঙ্গে দেবীকে পোড়া ল্যাটা মাছ নিবেদন করা হয়। আষাঢ় মাসে বিপত্তারিণী পুজো ও চৈত্র মাসে বাসন্তীপুজোয় ভিড় হয় বিশালাক্ষীর মন্দিরে। দেবী মন্দিরের পাশেই রয়েছে রঘুনাথ, গুপীনাথ ও জগন্নাথের মন্দির। সারা বছর দেবীকে তিন বেলা অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুজো এটি। ১০৯০ বঙ্গাব্দে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পূর্বপুরুষ নন্দকিশোর গোস্বামী পঞ্চমুণ্ডের আসনে সিদ্ধিলাভ করে গঙ্গাতীরে চারধাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্নাদেশ পান। সেই মতো রঘুনাথ, গুপীনাথ ও জগন্নাথ, মহাকালের উপর দণ্ডায়মান বিশালাক্ষীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পুজো শুরু করেন। নিম কাঠের তৈরি দেবী মূর্তির এক হাতে রয়েছে খড়্গ। অন্য হাতে দেবীর বরাভয় মুদ্রা। মূর্তির উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট। জনশ্রুতি রয়েছে, দেবীর দারু বিগ্রহে মুগ্ধ হয়ে বর্ধমানের রাজা গোস্বামীদের ৩৬৫ বিঘা জমি দান করে। এখানে দেবীর বিসর্জন হয় না। শান্তি ঘট ও গণেশ ঘটের বিসর্জন হয়। তিন বছর পর পর দেবীর অঙ্গরাগ করা হয়। মানুষের বিশ্বাস দেবী অত্যন্ত জাগ্রত। তিনি সকলের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন। দেবীর নামে দাঁইহাটের স্থানীয় পাড়ার নাম বিশালাক্ষী পাড়া। আজও রীতি মেনে বিশালাক্ষীর পুজো চলে।