জোব চার্নক কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা এবং ২৪ আগস্ট কলকাতার জন্মদিন। কলকাতার সবচেয়ে বড় মিথ হল এই লাইনটিই। প্রতিটি বাঙালিই এর সাথে পরিচিত এবং এর সাথেই ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠা। আর শুধু বাঙালিই বা বলি কী করে সারা পৃথিবীই এর সাথে পরিচিত। এটিই বাংলার সবচেয়ে বড় মিথ। বহুল প্রচলিত এই মিথের জোরেই অনেকেই মনে করেন, ২৪ শে আগস্ট ১৬৯০ সালে চার্নক কলকাতায় পদার্পণ করেন, সেই হিসেবে ২৪ আগস্টই হল কলকাতার জন্মদিন। আজ সারাদিনে দেখবেন সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়াল জুড়ে শুধুই শহর প্রেম আর তিলোত্তমা নিয়ে নস্টালজিয়া। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে মহানগরীর রূপকথা নিয়ে। তিলোত্তমা আমাদের সব্বার প্রেম, হয়তো প্রথম প্রেম। ট্রাম থেকে মেট্রো, ভিক্টরিয়া থেকে কফিহাউস কী নেই এ শহরে... আমাদের আনন্দনগরী, আমাদের দেশের সংস্কৃতির রাজধানী এই কলকাতা। প্যাশানের শহর। এ শহর ভালোবাসা দিতে জানে, ভালোবাসতে জানে, ভালোবাসায় রাখতে জানে।
কিন্তু আজ কি এ শহরের জন্মদিন? সত্যিটা কী? জোব চার্নক কি আদৌ কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা করেছিলেন?
১৬৯০ সালের ২৪ শে আগস্ট ছিল রবিবার। ঠিক দুপুর বারোটা নাগাদ প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে চার্নক সুতানটিতে এলেন। সারাদিন জাহাজেই থেকে সন্ধ্যায় নামলেন, পা রাখলেন সুতানটির মাটিতে। সঙ্গে ক্যাপ্টেন ব্রুক...তবে এই আসা কিন্তু চার্নকের প্রথমবারের জন্যে কলকাতায় আগমন ছিল না। এর আগেই তিনি দু বার কলকাতায় এসেছিলেন এবং বেশ কিছু কাল কাটিয়েও ছিলেন। তা যা বলছিলাম এ যাত্রায় প্রথম বারের জন্য কলকাতায় আসেননি। এটি ছিল তাঁর তৃতীয়বারের জন্য কলকাতায় আসা। আগে যখন তিনি দুবার এসেছিলেন কলকাতায়, তখনই তাঁর পছন্দ হয়েছিল সুতানুটিকে।
ব্যস এই আসা নিয়েই জন্মনিল মিথ। তৈরি হল নতুন এক ইতিহাস আর প্রচলিত হতে শুরু করল যুগ যুগ ধরে। হুজুকে বাঙালির আর কি, একটা দিন পেয়ে গেলেই হয়ে গেল। সে দেখলও না, ইতিহাস কি বলছে...
রাধারমণ রায় তাঁর ‘কলকাতা বিচিত্রা’ বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, ২৪ শে আগস্ট ১৬৯০ তারিখটি কলকাতার জন্মদিন নয়, আর জোব চার্নকও কলকাতার পত্তনকারী নন। কারণ ১৬৯০-এর বহু আগের বিভিন্ন সাহিত্যে কলকাতার উল্লেখ পাওয়া যায়।
প্রথমত, ১৪৯৫ সালে বিপ্রদাস পিপলাই রচিত মনসাবিজয় কাব্যে ‘কলিকাতা’র উল্লেখ আছে – ‘পূর্ব কূল বাহিয়া এড়ায় কলিকাতা/বেতোড়ে চাপায় ডিঙ্গা চাঁদো মহারথা।’
দ্বিতীয়ত, ১৫৯৪ থেকে ১৬০৬ সালের মধ্যে রচিত মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যেও রয়েছে কলকাতার উল্লেখ – ‘কলিকাতা এড়াইল বেনিয়ার বালা/বেতোরেতে উত্তরিল অবসান বেলা।’
তৃতীয়ত, ১৬৭৬-৭৭ সালে কৃষ্ণরাম দাস রচিত কালিকামঙ্গল কাব্যে কলকাতার উল্লেখ পাওয়া যায় – ‘অতি পুণ্যময় ধাম/সরকার সপ্তগ্রাম/কলিকাতা পরগণা তায়।’
চতুর্থত, ১৫৯০ সালে রচিত আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী'তেও কলকাতার কথা রয়েছে। এছাড়াও, ইংরাজদের নথিপত্রে ‘ক্যালকাটা’ নামটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন ১৬৮৮ সালের ২২ জুন চার্লস আয়ার ও রজার ব্র্যাডিলের লেখা একটি চিঠিতে এবং ১৬৯০-এর আগে ইংরেজদের একাধিক চিঠি ও রিপোর্টে এসেছে ‘ক্যালকাটা’ শব্দটি। অতএব, চার্নক আসার আগে থেকেই কলকাতার অস্তিত্ব ছিল।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০১ সালের ১লা আগস্ট বিখ্যাত সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার পরিষদ কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করে। সেই মামলায় বাদী পক্ষে ছিলেন রাধারমণ রায় সহ নয় জন কলকাতার সহনাগরিক এবং সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের তিনজন সদস্য।
মামলায় অন্য পক্ষ হিসেবে ছিলেন –
১। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য।
২। কলকাতা পুরসভা।
৩। কলকাতা পুরসভার মহানাগরিক।
৪। কলকাতা পুরসভার কমিশনার।
৫। পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষাবিভাগের সচিব এবং
৬। ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচারবিভাগের সচিব।
বাদীপক্ষের হয়ে আদালতে সওয়াল করেছিলেন স্মরজিৎ রায়চৌধুরী ও অজিত পাঁজা। প্রতিবাদী পক্ষের হয়ে লড়ে ছিলেন অ্যাডভোকেট বলাই রায়।
কলকাতা হাইকোর্টের দুই বিচারপতির নির্দেশে, ২০০২ সালে পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করা হয়ে। ওই কমিটির পাঁচজন সদস্যের প্রত্যেকেই ছিলেন স্বনামধন্য ঐতিহাসিক। তাঁরা হলেন নিমাইসাধন বসু, বরুণ দে, অরুণ কুমার দাশগুপ্ত, সুশীল চৌধুরী ও প্রদীপ সিংহ।
উক্ত কমিটির কাছে আদালত জানতে চাওয়া হয় -
১। কলকাতার কি জন্ম তারিখ রয়েছেন? যদি জন্ম তারিখ থেকে থাকে তাহলে কি সেটা ২৪ আগস্ট ১৬৯০, নাকি অন্য কোনো তারিখ?
২। জোব চার্নক কি কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা? তিনি না হলে, কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা কে?
দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর, কমিটির সদস্যরা রিপোর্ট তৈরি করেন এবং ২০০২ সালের নভেম্বরে কলকাতা হাইকোর্টে ঐ কমিটি রিপোর্টটি পেশ করে।
রিপোর্ট অনুযায়ী, কলকাতার নির্দিষ্ট কোনো জন্মতারিখ নেই। ২৪ শে আগস্ট ১৬৯০ তারিখের অনেক আগে থেকেই কলকাতার অস্তিত্ব ছিল। কলকাতার নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠাতাও নেই। জোব চার্নক কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা নন।
১৬ই মে ২০০৩ তারিখে, অ্যাভোকেট বলাই রায় কলকাতা হাইকোর্টে জানিয়ে দেন, রাজ্য সরকার বিশেষজ্ঞ কমিটির এই রিপোর্টটিকে মেনে নিয়েছে। তখন বিচারপতি অশোক কুমার মাথুর ও বিচারপতি জয়ন্ত বিশ্বাসের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দান করে যে, এরপর থেকে চার্নক-কে আর কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা বলা যাবে না। সেই সঙ্গে কলকাতার কোনো জন্মদিন আছে বলে, কোনো নির্দিষ্ট দিন গ্রাহ্য হবে না।
রাজ্য সরকার হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে কলকাতার জন্ম-তারিখ ও প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে জোব চার্নকের নাম সমস্ত পাঠ্যপুস্তক ও অন্যান্য নথি থেকে সরিয়ে দেয়। ইতিহাস এবং নানান বইতে, যেখানে যেখানে একথা লেখা ছিল তাও সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়। আগামী যেকোনো বইয়েও এই জাতীয় কোনো লেখার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। কিন্তু এসবের পরেও মানুষ প্রতি বছর ২৪ শে আগস্ট আসলেই, কলকাতার প্রেমে আবেগে আপ্লুত হয়ে যায়। এই তিলোত্তমা প্রেম অনেকটাই কলনিয়াল হ্যাংওভার। আসুন আবেগকে সরিয়ে আমরা ইতিহাসটিকে জানি আর মহানগরীর প্রতি ভালোবাসার উদযাপন তো যেকোনো দিনই হতে পারে। তার জন্য আলাদা দিনের দরকার নেই। প্রেমের শহর জুড়ে সারা বছরই প্রেমের মরশুম থাকে, এ কলকাতার মাঝেই আছে আরেকটা কলকাতা। তাকে হেঁটে দেখতে শিখুন। চিনতে শিখুন