কালীমায়ের জন্মকথা

চার বেদে দেবী কালিকার কোন উল্লেখ নেই, তাই তিনি বৈদিক দেবী নন। প্রাচীন বেদ, 'ঋক্' বেদের রাত্রিসূক্তে অবশ্য রাত্রিদেবীর কথা আছে, তিনি ঘোর কৃষ্ণবর্ণা ভয়ঙ্করী। কিন্তু, তিনি রাত্রিকালের দেবী, বর্ণ-লক্ষণ ছাড়া দেবী কালিকার সঙ্গে তাঁর কোন মিল নেই। তাই তাঁকে দেবী কালিকার আদিরূপ হিসেবে কল্পনা করা নেহাতই কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। 

উপনিষদের যুগে এসেও দেবী কালিকার কোন প্রসঙ্গ আমরা পেলাম না। এই যুগে নারীর মর্যাদা এবং নারীশক্তি বিদ্যা ও চর্যার মধ্য দিয়ে পুরুষের সমকক্ষ ছিল। নারীশক্তির দুর্দান্ত প্রতীক কালিকা। তাঁর উপাসনা সেকালে হয়ে থাকলে তার উল্লেখ নিশ্চয়ই তখনকার সাহিত্যে থাকত। সেটা যখন নেই, ভাবাই যায় যে, তখনও দেবী কালিকার রূপকল্পনা গড়ে ওঠেনি। আসলে আমাদের প্রতিটি দেবতারই তো জন্ম হয়েছে যুগের প্রয়োজনে, ভয়ভীত ভক্তের মনে। কালিকাও তাই। এই সময়ের গ্রন্থ ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’-এ দুই কৃষ্ণবর্ণা দেবীর উল্লেখ আছে ‘কৃষ্ণা’ ও ‘ঘোরা’। তাঁদের অস্ত্র, ‘পাশ’। কিন্তু, এই দেবীকেও কালিকা বলা যায় না। তবে, ‘মুন্ডক উপনিষদে’ প্রথম ‘কালী’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়--‘কালী করালী চ মনোজবা চ’ শ্লোকে। যদিও সেখানে 'কালী' শব্দটি যজ্ঞের আগুনের সাতটি জিহ্বার একটি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে, দেবী ‘কালিকা’ অর্থে নয়। 

আর্য সংস্কৃতির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে, সে আদিম অধিবাসীদের কাছ থেকে অনেক কিছুই ছিনিয়ে নিয়েছে, দেবতা থেকে শুরু করে উপাসনার সংস্কৃতি পর্যন্ত, অনেক কিছু। সেই ছলেবলে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিচিত উদাহরণ আছে জগন্নাথ কাহিনিতে। শবর সমাজের দেবতা 'নীলমাধব' হৃত হয়ে 'জগন্নাথ' নামে অধিষ্ঠিত হয়েছেন আর্যমণ্ডলীতে। দেবী কালিকার জন্ম ইতিহাসেও এরকমই এক ঐতিহ্য লুকিয়ে আছে। খ্রিস্টীয় সপ্তম ও অষ্টম শতকের গ্রন্থাবলীতে এর উল্লেখ আছে। গ্রন্থগুলি হল, বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’, বাকপতিরাজের ‘গৌড়বহো’ এবং ভবভূতির ‘মালতীমাধব’। সেখানে দেবী শবরপূজিতা, পর্ণপত্র তাঁর আবরণ ও আভরণ, তিনি রক্তলোলুপা এবং নরমাংস লোভী। ইনি কৃষ্ণবর্ণা এবং শ্মশানে এঁর অবস্থান। এই সময়কালটিতেই বৌদ্ধধর্মের একটা বড় অংশ সহজ মোক্ষপথ ছেড়ে বেছে নিয়েছিলেন সহজিয়া তন্ত্রপথ। যৌনতার মধ্য দিয়ে বীরসাধনাকে অবলম্বণ করে মোক্ষ খোঁজার এ এক জটিল পথ। সেই পথে তাঁদের উপাস্য হয়েছিলেন, ‘তারা’ ও ‘একজটা’ নামের দেবী। এই দুই দেবীই ঘোরবর্ণা, ভীষণদর্শনা। একটা সময়ে এই সাধনাকে ছুঁতো করে যৌনতাই মুখ্য হয়ে উঠল অধিকাংশ সাধকের কাছে, ফলে, শুরু হল সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয়।

দীর্ঘ সময় ধরে বৌদ্ধধর্মের চাপে হিন্দুধর্ম একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল, কিন্তু, এই সময়কালে তন্ত্রপথে বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয়ের সুযোগ নিয়ে হিন্দুধর্ম আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে গিয়ে যৌনতার গোপন আকর্ষণে বৌদ্ধতন্ত্রের বীরসাধনাকেই আপন করে নিলেন এক শ্রেণির হিন্দু উপাসক। সেইসঙ্গে আপন করে নিলেন রক্তপাতে দেবীকে তুষ্ট করার সহজ শবরপন্থা। শবরপূজিতা রক্তলোলুপা শ্মশানবাসিনী দেবী এবং বৌদ্ধতন্ত্রের দেবী ‘তারা’ ও ‘একজটা’ মিলেমিশে তাঁদের হাতেই জন্ম হল 'দেবী কালী'র। উপাসকদের ধ্যানকল্পনায় গড়ে উঠল তাঁর নানান রূপ। পরবর্তীকালে পুরাণগ্রন্থগুলির মধ্যে সংযোজিত হল কালীকাহিনি। 'মহাভারত'-এ তাঁর কথা প্রক্ষিপ্ত হল। 'মার্কণ্ডেয় পুরাণ'-এ সংযোজিত হল কালিকার উদ্ভব-কাহিনি :

দেবী দুর্গা একবার চণ্ড নামক অসুরকে বধ করতে অসমর্থ হয়ে যখন রাগে কৃষ্ণবর্ণা হয়ে উঠলেন, তখনই তাঁর কপাল থেকে আবির্ভূতা হলেন উগ্রা এক দেবী। সেই দেবীর গাত্রবর্ণ ঘোর কালো বলে, তাঁকে অভিহিত করা হল, 'কালিকা' নামে। তিনিই সেই দুর্বধ্য চণ্ড অসুরকে বধ করলেন, রক্তবীজের রক্ত পান করে তাকে হত্যা করলেন। এখান থেকেই তিনি হয়ে উঠলেন দেবী দুর্গারই আর এক রূপ। কল্পনা করা হল, কালীই মহাদেবের প্রথম পত্নী, কালো রঙের জন্য গঞ্জনা শুনতে শুনতে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে তপস্যার মাধ্যমে গৌরবর্ণা হয়ে জন্ম নেন হিমালয়ের ঘরে, তখন তাঁর নাম হয়, 'গৌরী'। এই রূপেই তিনি শিবকে আবার বিয়ে করেন। হয়ে ওঠেন একাধারে অস্ত্র হাতে সংহারের দেবী এবং মাতৃরূপে মঙ্গলময়ী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...