প্রকৃতির উপাসক, নাট্যকার থিয়াম
আদিবাসী ঐতিহ্যের সঙ্গে বর্তমানে সংস্কৃতির সেতুবন্ধন-তাঁর কাছে থিয়েটারের মূল মন্ত্র।
‘’সভ্যতা , সংস্কৃতি এসব বলতে আমরা কী বুঝি ? এই সব কোট -প্যান্ট পরা , মোবাইল হাতে ঘোরা , ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকা --- এই সব ? একেবারেই না৷ এ সব তো আর্টিফিসিয়াল জিনিস , নকল৷ সভ্যতা -সংস্কৃতির সঙ্গে এদের সম্পর্কই নেই৷ বরং এ সবের মধ্যে থেকে আমরা সত্যিকারের সভ্যতা থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি৷ শিকড়ে ফেরার জন্যই আদিবাসী সংস্কৃতিকে জানা দরকার’’৷
কথাগুলো রতন থিয়ামের। মনিপুরের নাট্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর লেখায় নাটকে শিকড়ের সুগন্ধি লেগে থাকে। বর্তমানে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা-র চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। জীবনের বাহাত্তরতম পাতা ওল্টালেন।
জন্ম মণিপুরেই। সেখানেই ১৯৭৬ সালে নিজের নাটকের দল কোরাস রেপার্টরি থিয়েটার এর সূচনা।
রতন থিয়াম তাঁর নাট্য প্রযোজনাগুলোতে মানুষের যন্ত্রণাকে তুলে ধরেছেন মণিপুরি দৃষ্টিকোণ থেকে এবং তাঁর মতো করে ।
একটি আয়নার এক পারে রতন থিয়াম দাঁড়ালেন। অন্যদিকে, দেখতে পাওয়া যাবে হেনরিক ইবসেন কে। দু’জনের শিল্পী সত্তার নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে।সমাজে বর্তমান সমস্যাগুলোর ছবিই ভেসে ওঠে ওঁর কাজে।
রতনের বেশিরভাগ নাটকের আধার যুদ্ধ ও সংগ্রামের ধ্বংস ক্ষমতা। কয়েক বছর ধরেই তাঁর নির্দেশিত নাটকগুলোতে ভাসা ভাসা আশাবাদ দেখা যাচ্ছে। এই আশাবাদ আবর্তিত হচ্ছে। জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে একটি নতুন সমাজের সূচনা, পুনর্মিলন ও শাস্তি প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে।
প্রযোজনাগুলো খুবই দৃষ্টিনন্দন এবং শিল্পীদের অভিনয়ের তেজ একটা উপরি পাওনা। তিনি নাটকের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন মহাকাব্য, পৌরাণিক কাহিনি ও লোককাহিনির আঙ্গিকে।
মণিপুরের ঐতিহ্যবাহী সংগীত, নৃত্য, মার্শাল আর্ট এবং অন্যান্য আধুনিক ও সমসাময়িক নাট্য উপাদান ও যান্ত্রিক কলাকৌশলে সবই চোখের উপহার। সব মিলিয়ে রতন থিয়ামের নাট্য প্রযোজনাগুলোকে বলা যায় সাইকো- ফিজিক্যাল।
মহাভারতে কর্ণের মানসিক টানাপোড়েন নিয়ে লেখা নাটক 'কারানাভারাম', 'ইম্ফল ইম্ফল', চক্রব্যুহ, কালিদাস অবলম্বনে ‘ঋতুসমহরম’ ,রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা ‘ অনুসরণে দ্য কিং অফ ডার্ক চেম্বার – এর মতো প্রযোজনা করেছেন।
ম্যাকবেথ তাঁর অন্যতম সেরা প্রযোজনা । মঞ্চস্থ হয়েছিল কলকাতাতেও। থিয়ামের চোখে এই নাট্যকে অন্যভাবে অনুভব করা যায়। তাঁর দর্শনে ‘ম্যাকবেথ’ একটা রোগ এর নামান্তর।
সমস্ত কাব্যগুণ, যাবতীয় ধ্রুপদী বৈশিষ্ট্য, টানটান গঠন- সব কিছুকে স্বীকার করেও যে বয়ানটি বের করে আনল, তা হল ‘মাটির গন্ধ’৷ আমার দেশে মানুষের সংগ্রাম, লড়াই, অভিশাপ, পাপ- সমস্ত কিছুর ইতিবৃত্ত৷
তাঁর কবিতার বই ‘নির্বাচিত কবিতা’ প্রতাশিত হয়েছে বাংলায়। দুটি কাব্যসংগ্রহ ‘তালাপামেল নাহাকসু’ এবং ‘সনাগী থম্বাল’-এ প্রকাশিত কবিতাগুলির মধ্য থেকে ২০৫টি কবিতা স্থান পেয়েছে এই বইয়ে।
নির্যাতন, সন্ত্রাস ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে রতন থিয়াম হচ্ছেন এক বলিষ্ঠ কণ্ঠ।পাশাপাশি রক্তে মিশে আছে মাটির দলা। এমন একজন অন্তরমুখী, অনুভবী নাট্যকার কে জন্মদিনে প্রণাম।