“তুমি যেখানেই যাও,/ কোনো চকিত মুহূর্তের নিঃশব্দতায়/ হঠাৎ শুনতে পাবে/ মৃত্যুর গম্ভীর, অবিরাম পদক্ষেপ। আর, আমাকে ছেড়ে তুমি কোথায় যাবে?/ তুমি যেখানেই যাও/ আকাশের মহাশূণ্য হতে জুপিটার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি/ লেডার শুভ্র বুকে পড়বে।” -(তুমি যেখানেই যাও, সমর সেন)
এক একজন কবি এমনও থাকেন, যিনি কবিতা না লেখার ইস্তেহার জানাতে পারেন যেকোনও সময়। বিরোধ বা বৈপরীত্য সহ্য করতে না পেরে একসময় কবিতা লেখাই ছেড়ে দেবার কথা ভেবেছিলেন, এরকম একজন কবি সমর সেন। তবে একজন প্রকৃত কবির সঙ্গে কবিতা লেখা ছাড়া বা ধরার তেমন কোনও অনুশাসন জড়িত থাকে না। তা স্বয়ং, স্বয়ম্ভূ। তাঁর কবিতায় সে উল্লেখ মেলে। যেমন তিনি বলেছেন- ‘মহাশূণ্য হতে জুপিটার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি’, ‘লেডার শুভ্র বুকে পড়বে’, ‘তুমি যেখানেই যাও, কোনো চকিত মুহূর্তের নিঃশব্দতায়'।
সমর সেনের গদ্যকবিতাগুচ্ছের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু দেখতে পেয়েছিলেন ‘রাবীন্দ্রিক রোমান্টিকতার সেই শেষ মধুর সৌরভে-ভরা দীর্ঘশ্বাস’। সমর সেন স্বগোক্তিতে বলেছেন ‘বেহালা থেকে সকালে বেরিয়ে ফিরতাম অনেক রাতে। বাবা কোন খবর রাখতেন না। এমনও হয়েছে যে কলকাতার বাইরে বেশ কিছুদিন ঘুরে এসেছি, বাবা জানতে পারেননি।… তখন যৌবনের নানা অভিজ্ঞতার ফলে কবিত্বশক্তি প্রখর হয়েছে। কলকাতায় যাতায়াতের সময় ট্র্যামের গতিছন্দ হয়তো গদ্যছন্দের মূলে ছিল।’
শঙ্খ ঘোষ মনে করেন, ‘গদ্যে… লেখকের চেতনা বইতে থাকে হাজার শাখা-প্রশাখায়, তার বিস্তার প্রধানত বাইরের দিকে। অন্তর্মুখী বিষয়কেও গদ্য ধরতে চায় তার বাইরের দিকে উদ্ঘাটন করে। কবিতায় আছে এর উলটো চলন। কবিতা বাইরের বিশ্বকেও আয়ত্ত করতে চায় ভিতরের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে। এক-একটা মুহূর্ত আসে যখন আমাদের বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতা, আমাদের বোধি আর প্রেরণা সমবেতভাবে সংহত হয় চেতনার এক কম্পমান বিন্দুতে, তৈরি হয় যেন শিখার মতো দীপ্যমান একটি রেখা, এই রেখাটিকে বিন্যস্ত করতে পারার মধ্যেই কবিতা রচনার করণকৌশল লুকোনো। তখন তার যে-অবয়ব তৈরি হয় – তার ছন্দ এবং ভাষা – তার মধ্যে প্রায় স্পষ্টতই যেন দেখতে পাওয়া যায় এই কম্পন।’
বুদ্ধদেব বসু সমর সেনের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রপাত সম্বন্ধে বলেছেন, ‘এক গ্রীষ্মের সকালে আমার ঘরে একটি ক্ষীণাঙ্গ ছেলে-প্রায় বালক, সবে পা দিয়েছে যৌবনে – গায়ের রং হলদে-ঘেঁষা ফর্সা, ঠোঁটে গোঁফের ছায়া, চোখে চশমা, গালে একটি ব্রণের ওপর এক ফোঁটা চুন লাগানো। কিছুমাত্র ভূমিকা না করে বলল, আমি আপনার ‘শাপভ্রষ্ট’ কবিতার একটি ইংরেজি করেছি। – আপনি দেখবেন?’ বুদ্ধদেব সমর সেন সম্পর্কে অকপটে বলেছিলেন, ‘যে যুগে বিশ্বাস করা সহজ নয়, কবির পক্ষে সেটা দুঃসময়। বর্তমান সময়ের সংশয়াচ্ছন্ন অন্ধকার যে-তরুণ চিত্তকে আবিষ্ট করেছে, সমর সেন তারই প্রতিনিধি।’
বুদ্ধদেব বসুকে লেখা চিঠিতে কবিতা পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রশংসা করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘তোমাদের ‘কবিতা পত্রিকা’ পড়ে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি। এর প্রায় প্রত্যেক রচনার মধ্যেই বৈশিষ্ট্য আছে। সাহিত্য-বারোয়ারির দল-বাঁধা লেখার মতো হয়নি। ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য নিয়ে পাঠকদের সঙ্গে এরা নূতন পরিচয় স্থাপন করেছে।’ শুধু এইটুকুতেই থামেননি রবীন্দ্রনাথ। কবিতার প্রায় সব কবিকে ধরে-ধরে নিজের মতো করে মন্তব্য করেছিলেন। তখনও পর্যন্ত তিনি কবি বা ব্যক্তি সমর সেনকে চিনতেন না। তাঁর কবিতা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘সমর সেনের কবিতা কয়টিতে গদ্যের রূঢ়তার ভিতর দিয়ে কাব্যের লাবণ্য প্রকাশ পেয়েছে। সাহিত্যে ওঁর লেখা ট্যাঁকসই হবে বলেই বোধ হচ্ছে।’
সমর সেনের পিতামহ ছিলেন স্বনামধন্য দীনেশচন্দ্র সেন, বারো বছর বয়সে মায়ের অকালমৃত্যু, পনের বছর বয়সে অধ্যাপক পিতার দ্বিতীয় বিবাহ, সতেরো বছর বয়সেই আন্তর্বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা শ্রীহর্ষে প্রথম ছাপা কবিতা, পরের বছরে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে পরিচয় আর তার পরের বছরেই 'কবিতা' পত্রিকায় বুদ্ধদেব, প্রেমেন্দ্রের সঙ্গে সম্পাদকীয় পদ প্রাপ্তি। ১৯৩৬-এ লন্ডনে TLS-এ এডোয়ার্ড টমসন আধুনিক ভারতীয় কবিতা নিয়ে বলতে গিয়ে সমর সেনের দুটি কবিতার অনুবাদ ও প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। এই সব নাটকীয় অগ্রসরণ নিয়েও বি. এ. অনার্স ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম, পদক ও স্কলারশিপ লাভ। ১৯৩৭-এই বেরুল 'কয়েকটি কবিতা' যা উৎসর্গ করা হল ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফফর আহমেদকে। বাড়িতে অবস্থান ছিল বঙ্কিম মুখার্জি, রাধারমণ মিত্র, মাঝে মাঝে মুজফফর আহমেদ এবং আরও কোনো কোনো বামপন্থী ব্যক্তিত্বের। অথচ সমর সেন কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য হলেন না, কোনো দিনও পার্টির নানা ভগ্নতাতেও তাঁকে সদস্য হিসেবে পাওয়া যায়নি। তবে ১৯৩৭-এ নির্বাচনী প্রচারে বঙ্কিমবাবুর সঙ্গে আসানসোল যান। ১৯৩৮-এ এম. এ. ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। এ বছরই কামাক্ষীপ্রসাদ, বুদ্ধদেব, প্রতিভা প্রভৃতির সঙ্গে রবীন্দ্র সন্দর্শনে শান্তিনিকেতন যাত্রা। সে-বছর নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সম্মেলনের ৩য় অধিবেশনে পড়েন In Defence of the Decadents--যা নিয়ে বিতর্ক চলে বহুকাল। 'গ্রহণ' বেরুল ১৯৪০-এ, উৎসর্গ করা হল বুদ্ধদেব, রাধারমণ ও বিষ্ণু দে কে। একজন অ্যান্টি ও দু’জন প্রো-কমিউনিস্ট। আবু সয়ীদ 'আধুনিক বাঙলা কবিতা'র ভূমিকায় লিখেছেন — 'সমর সেনের তো রীতিমত একটি স্কুল গড়ে উঠেছে।' কবিতাপ্রিয় স্বদেশবাসী, বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী আলোচকরা কেউই তাঁর হাজিরাকে অস্বীকার করতে পারেন নি। 'নানাকথা' (১৯৪২), 'খোলা চিঠি' (১৯৪৩), 'তিনপুরুষ' (১৯৪৪) বেরুল, স্টেটসম্যান পত্রিকায় সাব এডিটর পদে চাকরি (১৯৪৯) তার আগে বিজ্ঞাপন অফিসে দিন সাতেক (১৯৪৪), দিল্লীর অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে কাজ (১৯৪৪), কাঁথির প্রভাতকুমার কলেজে চাকরি (১৯৪০), দিল্লীর কমার্শিয়াল কলেজে চাকরি (১৯৪০), বিয়ে (১৯৪১) — গোড়া থেকেই একটা অস্থিরতা অব্যাহত। এরপর অনুবাদকের চাকরি নিয়ে মস্কো যাত্রা (১৯৫৭), দেশে ফেরা, বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ (১৯৬১), হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড-এ যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে যোগদান (১৯৬২), তারপর 'নাউ' পত্রিকার সম্পাদক (১৯৬৪) পদ ত্যাগ ক'রে ফ্রন্টিয়ার সাপ্তাহিক-এ সম্পাদনার দায়িত্ব (১৯৬৮)।
সমর সেন এমন একজন, যিনি নিজেকে ‘বিপ্লবী’ মনে করেননি কখনও, অথচ লিখেছেন বিপ্লবের জন্য, বিপ্লবীদের জন্য। নগরজীবন, সর্বহারা, কৃষক-শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তির পংক্তি বাঁধতেন, যা প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর কয়েকটি কবিতা(১৯৩৭), নানাকথা(১৯৪২), তিনিপুরুষ(১৯৪৪), সমর সেনের কবিতা(১৯৫৪)য়। তাই একুশ শতকেও তাঁর মত একজন ব্যাক্তিত্বের জন্মদিন মনে রাখার। আর মনে রাখার তাঁর কবিতার বোধ। যেমন-
“সমুদ্র শেষ হলো, আজ দুরন্ত অন্ধকার ডানা ঝাড়ে উড়ন্ত পাখির মতো। সমুদ্র শেষ হ’লো গভীর বনে আর হরিণ নেই, সবুজ পাখি গিয়েছে ম’রে, আর পাহাড়ের ধূসর অন্ধকারে দুরন্ত অন্ধকার ডানা ঝাড়ে উড়ন্ত পাখির মতো। সমুদ্র শেষ হ’লো, চাঁদের আলোয় সময়ের শূণ্য মরুভূমি জ্বলে।” –(স্বর্গ হতে বিদায়, সমর সেন)