তিনি যেভাবে মুন্ডা সমাজের ব্যথা অনুভব করেছিলেন তেমনটা আর কেউ করেনি। উপজাতি মুন্ডা সম্প্রদায় তাঁকে ‘ঈশ্বর’ মানত। যিনি গরিব অসহায় নিপীড়িত মানুষগুলোর ঘাম রক্ত আর কান্নার গল্প জানতেন। বিরসা মুন্ডা। শুধু প্রান্তিক মুন্ডা সম্প্রদায় নয়, ভারতীয় রক্তের তেজ বুঝিয়েছিলেন ইংরেজদের।
১৫ নভেম্বর ১৮৭৫ সালে বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যের রাচির উলিহাতু গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা সুগনা মুন্ডা মাতা করমি হাতু। ছোটবেলায় সালগা গ্রামে পড়াশোনা করার পর চাইবাসার মিশনারী স্কুলে পড়াশোনা করেন। স্কুলে পড়ার সময় তাঁর শিক্ষক জয়পাল নাগ তাঁর জীবন, সমাজ, মানুষ দেখার চোখ বদলে দেন। বিরসা দেখেন খাদ্য এবং শিক্ষার বিনিময়ে জোর করে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা চলছে। প্রতিবাদে তিনি মাঝপথেই জার্মান মিশনারী স্কুল ছেড়ে দেন।
তাঁর বাবা ছিলেন বর্গা কৃষক। ছোটবেলা থেকে বিরসা অন্যরকম। চারপাশের মানুষগুলোর দুঃখ যন্ত্রণা ক্ষোভ আচ্ছন্ন করে রাখত তাঁকে। ইংরেজ আর ‘দিকু’দের হাত থেকে বাঁচবার কোনও পথ কি নেই? কেন মানতে হবে তাদের এক তরফা নির্যাতন? উত্তর খুঁজতেন কিন্তু সমাধান সহজ নয়। ক্ষোভ জমতে জমতে একদিন বিক্ষোভ ঘনিয়ে উঠল।
বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে ১৮৯৯-১৯০০ সালে ‘মুন্ডা বিদ্রোহ’ সংগঠিত হল। রাঁচির দক্ষিণাঞ্চলে সৃষ্ট এই বিদ্রোহকে মুন্ডারি ভাষায় বলা হয় ‘উলগুলান’। যার অর্থ ‘প্রবল বিক্ষোভ’। এই বিদ্রোহের মূল লক্ষ্য ছিল মুন্ডা রাজ ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা। বন্দুকের সামনে তীর-ধনুক নিয়ে লড়াই।
ব্রিটিশরা মুন্ডা উপজাতির মানুষকে দাস বানিয়ে শোষণ করবে। তাদের সব কিছু নিজেদের মুনাফায় লাগবে এ তিনি মানতে পারেননি। তাই নিজের জান কবুল করেছিলেন ইংরেজ অত্যাচার আর ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে লড়াইতে। কৃষকদের বলেছিলেন গোরা সাহেবদের খাজনা না দিতে। ছোটনাগপুরে ডুমবারি পাহাড়ে ব্রিটিশ সেনার সঙ্গে বিরসা ও তাঁর অনুগামীদের যুদ্ধ হয়।
বিদ্রোহের ফল হিসেবে গ্রেফতার হন বিরসা। সঙ্গে শতাধিক সঙ্গী। বিচারে বিরসা মুন্ডা ও ধৃত অন্য দুজনের ফাঁসির হুকুম। ১২ জনের দ্বীপান্তর। ৭৩ জনের দীর্ঘ কারাবাসের সাজা ।
যে কদিন কারাজীবনে ছিলেন। নির্যাতন কম হয়নি। শেষ পর্যন্ত ফাঁসির দিন উপস্থিত। কিন্তু তার ঠিক আগের দিন ৯ই জুন ১৯০০ সালে রাঁচি জেলের অভ্যন্তরে বিরসার খাবারে বিষ মেশানো হল। পরদিন জানা গেল বিষ ক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে বিরসার।
বিরসা শুধু মাত্র যে ইংরেজদের বিদ্রোহ করেছিলেন এটুকু বললেই তাঁর ইতিহাস সমাপ্ত হয় না। তাঁর ব্যাপ্তি আরও বিশাল। আদিবাসী সমাজ তাঁকে ঈশ্বর মানত। ‘বিরসাইত’ নামে এক নতুন ধর্মের সূচনা করেছিলেন। সেই ধর্মের মূল কথা ছিল একেশ্বরবাদ। তাঁকে ভালোবেসে ‘ধরতি আব্বা’ নামে ডাকত মানুষ। উপজাতি মানুষদের তাদের নিজের শিকড়ে ফেরাতে চেয়েছিলেন। সেটাই ছিল ২৫ বছরের যোদ্ধার আজীবনের সংগ্রাম।