রেডিওর প্রাণপুরুষ তিনি। নিজের প্রাণ কিন্তু সঁপেছিলেন নাটকের দুনিয়াকে। ছোটবেলা থেকেই টান নাটকের প্রতি। নাটকের টানেই তিন তিনবার নাম বদল। মেঘদূত। বিষ্ণুশর্মা। বিরূপাক্ষ। ছদ্ম নামের আড়ালে আসল মানুষটি হলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
জন্ম থিয়েটার পাড়ায়। বাড়ির বাতাসে ভেসে বেড়াত গান আর কবিতা। তাই শুরুটাই হয়েছিল একেবারে অন্য ভাবে। একেবারে ছেলেবেলা থেকেই হাতে উঠেছিল শেক্সপিয়ার। ঠাকুমার কাছে পড়তেন। শুদ্ধ ইংরেজি, ভরাট টান। কোথাও এতটুকু তাল কাটার পরিসর নেই। ঠাকুমা বুশিকে হাতে ধরে শেখাতেন স্পষ্ট উচ্চারণে কীভাবে পড়তে হয় ইংরেজী নাটক। সংস্কৃত পাঠও চলত ওই সময়েই।
বয়স তখন আট বছর। মাস্টারমশাই রাজেন্দ্র নাথ দের ইচ্ছেতে বেলুড়মঠ যেতেন মঠের সন্ন্যাসীদের আবৃত্তি শোনাতে। ওই সময়েই জীবনে প্রথমবার চন্ডী পাঠ। মাস্টার মশাইয়ের বাড়ির দুর্গাপুজোয়।
প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর পর্ব। সেই শুরুটা এভাবেই হয়েছিল। স্কুলের ছাত্র বীরেন্দ্র কম্বুলিয়া টোলার চিত্রা সংসদ আর অর্ধেন্দু পাঠাগারের সদস্য ছিলেন। অভিনয় চর্চার শুরুটা সেখানেই।
নিজেই এক স্মৃতি কথায় জানিয়েছেন, তাঁর বাবা কালীকৃষ্ণ ভদ্রের কাছে মামলার সূত্রে কলকাতার প্রায় সব থিয়েটারের মালিকরা আসতেন। প্রত্যেক মাসে থিয়েটারের কিছু না কিছু পাস জমা হত সেভাবে। বাড়ি শুদ্ধু লোক ঘোড়ার গাড়ি চেপে থিয়েটার দেখতে যাওয়া হত।
বঙ্কিম চন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের লেখা ‘সীতারাম’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। সেই বই উৎসর্গ করেন তাঁর বাবাকে।
স্কটিশচার্চ কলেজে যখন পড়তেন তখনও চিত্রা সংসদে নিয়মিত নাটক করছেন। সেই সূত্রেই যোগাযোগ হয়েছিল গার্সটিন প্লেসের সদ্য প্রতিষ্ঠিত বেতার কেন্দ্রে।
১৯২৮-এ ২১ আগস্ট পরশুরামের ‘চিকিৎসা সঙ্কট’-এর নাট্যরূপ পরিবেশিত হল তাঁর পরিচালনায়। এর পর অজস্র পরিবেশনা। রেডিও নাটকের জগতে রাধারমন মিত্র লেনের বুশি চিরকালের জন্য চেনা হয়ে উঠলেন ‘ফাদার অব রেডিও ড্রামা’ হিসেবে।
এক একটা নাটক গোটা পাঠ করতে পারতেন। এক দিনে দুটো করে। এমনকি বিরতির কনসার্টও হুবহু মুখে বাজিয়ে শোনাতেন। অথচ রেডিও জীবনের শুরুতেই তাঁকে বাদ পড়তে হয়েছিল। যে মেঘমন্দ্রিত কন্ঠ স্বরের জন্য তিনি ‘বাঙালির বীরেন্দ্রকৃষ্ণ’ ঠিক
সেই কন্ঠ স্বরের কারণেই। রেডিওতে অডিশন দিতে গিয়ে ‘পাশ’ করতে পারেননি। মেঘদূত নামটি প্রথম। কিন্তু সেই নাম প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় ফের নাম বদল। রম্য রচনা লিখতেন ‘বিরূপাক্ষ’ নামে। বেতারের জন্য তৎক্ষণাৎ নাটক লিখে দিয়েছেন অনেকবার। তবে তিনি কোনও দিন মঞ্চাভিনয়ে রাজি হন নি। প্রস্তাব প্রতিবার
ফিরিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘আমি সকলকে রঙ মাখাবো, নিজে মাখব না'। মঞ্চ, বেতারের পাশাপাশি রেকর্ড নাটকের জন্য নাটক লিখেছেন, পরিচালনা করেছেন, নিজেও কন্ঠ দিয়েছেন নিয়মিত। ১৯৩৫- এ সেনোলা রেকর্ডের জন্য ‘সীতা’ নাটক লিখেছিলেন বিষ্ণুশর্মা ছদ্মনামে। রেকর্ড নাটকে রাম হয়েছিলেন তিনি নিজেই। স্টার থিয়েটার, মিনার্ভা, রঙমহলে অজস্র মঞ্চ সফল থিয়েটারের নেপথ্য পুরোহিত তিনি। শুধু নাটক লেখা বা নাট্য রূপ দেওয়াতেই তাঁর কাজ শেষ হয়ে যেত না। অভিনেতা অভিনেত্রী তৈরি থেকে নাটক পরিচালনা তো বটেই প্রযোজনার প্রতিটা খুঁটিনাটিতে তাঁর নজর থাকত। অভিনেতা অভিনেত্রী তৈরিতে তাঁর যত্ন প্রবাদ হয়ে গিয়েছিল। সিনেমার রাগী বাবা’র ভূমিকায় জনপ্রিয় অভিনেতা কমল মিত্র যখন যাত্রায় যোগদান করলেন তখন কণ্ঠস্বর শিখতে আসতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কাছে। বাংলার মঞ্চ দর্শকদের মানসিকতা নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ ‘কখন কোন নাটক জমবে আর কোন নাটক জমবে না - তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে সাধারণ দর্শকদের চাহিদার ওপর’।
মহিষাসুরমর্দিনীর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছেন আদ্যন্ত নাটকের মানুষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। নাটকের জগতে তাঁর অভিজ্ঞতা এবং দেখা বাংলা নাটকের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ দলিল, চর্চার ইতিহাস হয়ে উঠতে পারত কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। তিনি নিজে যতটুকু লিখে গিয়েছেন তাঁর বিপুল কাজকে জানতে সেটুকু যথেষ্ট নয়। তাই আক্ষেপ থেকেই যাবে।
তথ্য ঋণ (তাঁতঘর একুশ শতক পত্রিকা: বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র সংখ্যা)