শ্রী চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের রচিয়তা শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজের নাম বৈষ্ণব সমাজে রীতিমতো অক্ষয় হয়ে আছে। বৈষ্ণব সাহিত্যে তাঁর অবদান প্রচুর হলেও আত্মপ্রচারে তিনি সবসময় বিমুখ থেকেছেন। পরম বৈষ্ণব কৃষ্ণদাস কবিরাজের পিতা মাতার নামের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে যেটুকু জানা যায় নৈহাটির কাছে ঝামটপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে। জাতিতে তিনি ছিলেন বৈদ্য।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রতি রীতিমত অনুরক্ত ছিলেন শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ। মহাপ্রভুকে কখনও তিনি চোখে দেখেননি, তা সত্ত্বেও চৈতন্যদেবকেই তিনি ধ্যান জ্ঞান বলে মনে করতেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে চৈতন্য মহাপ্রভুকে তিনি অভিন্ন ভাবে দর্শন করতেন। কৃষ্ণ নাম জপ ও কীর্তন করে তিনি সবসময় বিভোর হয়ে থাকতেন এবং নাম গান করতে করতে অনেক সময় তিনি বাহ্যজ্ঞানও হারিয়ে ফেলতেন। একদিন অবিরাম গান করতে করতে কৃষ্ণদাস কবিরাজ ঘুমিয়ে পড়েছেন ঘুমের মধ্যে তিনি এক বিচিত্র স্বপ্ন দেখলেন। তিনি দেখলেন নিত্যানন্দ মহাপ্রভু তার সামনে এসেছেন এবং এসে তাকে বলছেন , "তুমি বৃন্দাবনে যাও সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করো।"
এই স্বপ্ন দেখার পর কৃষ্ণদাস কবিরাজের মন চঞ্চল হয়ে উঠল। তিনি ঝামটপুর ত্যাগ করলেন, এরপর বহু পথ, বহু স্থান পরিক্রমা করে তিনি উপস্থিত হলেন বৃন্দাবনে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সেখানে ছিলেন রূপ গোস্বামীর কাছ থেকে তিনি দীক্ষা নেন এবং সনাতন ও জীব গোস্বামীর থেকেই তিনি বৈষ্ণব শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। শ্রীচৈতন্যের লীলা কাহিনী অবলম্বনে গ্রন্থ রচনা করার ইচ্ছা তার মনে অনেক দিন থেকেই ছিল বৃন্দাবনে আসবার পর সেই আগ্রহ আরও প্রবল হয়ে যায়। সকলে তাকে সেই অনুরোধ করতে থাকে।
বৃন্দাবনে বসবাসরত বৈষ্ণব ভক্ত মন্ডলী তাকে শ্রীচৈতনের অন্তলীলা বর্ণনা করতে অনুরোধ করেন, কিন্তু কৃষ্ণদাস কবিরাজ রাজি হন না। আসলে কৃষ্ণদাস নিজের বয়সের কথা ভেবে এবং অবস্থার কথা ভেবে এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে একটু অস্বস্তি বোধ করেন। এমন সময় গোবিন্দজীর মন্দিরের এক পূজারী দেবতার প্রসাদি নির্মাল্য এনে তার হাতে অর্পণ করলে তিনি এটাকেই দেবতার নির্দেশ বলে মনে করেন। এরপর তিনি চৈতন্যচরিতামৃত রচনা করার কাজ শুরু করেন ১৬১৫ সালের জুন মাসে, ১২০৫১ টি শ্লোক সমন্বিত এই মহাগ্রন্থটি শেষ করতে তার মোট নয় বছর সময় লাগে। ১৬২৪ সালে শ্রীকৃষ্ণ দাস শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থ রচনা শেষ করেন।
এরপর নিভৃত নির্জনে বসে তিনি শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করছিলেন এবং এক মনে গ্রন্থ রচনা করতেন। চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ পার্ষদ রঘুনাথ দাস গোস্বামীর কাছ থেকে তিনি চৈতন্য মহাপ্রভুর শেষ জীবনের লীলা সম্পর্কে অবগত হন এবং সেটিকে লিখে রাখেন। এরপর বৃন্দাবন ধামের বৈষ্ণব আচার্যবৃন্দ অনুমোদন করার পর গ্রন্থাগার গৌড়ে এটি পাঠানো হয় কিন্তু পথে বনবিষ্ণুপুরের রাজা বীর হাম্বিরের অনুচরেরা মহামূল্য এই বইটিকে রত্ন সম্ভার মনে করে পেটিকাটি অপহরণ করে। এই খবর বৃন্দাবনে এসে পৌঁছালে ভগ্নহৃদয় কৃষ্ণদাস প্রাণ ত্যাগ করেন। পরে অবশ্য গ্রন্থখানি উদ্ধার করা হয়েছিল এবং এই গ্রন্থের খ্যাতি পৌঁছে গিয়েছিল গৌড়বঙ্গে থেকে শুরু করে সমগ্র দেশে।