জীব গোস্বামীকে কেন আশ্রম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন রূপ গোস্বামী?

চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রয়াণের পর রূপ ও সনাতন গোস্বামীর বংশের উত্তর পুরুষ জীব গোস্বামী‌ বৃন্দাবনে ভক্তি রসের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। রূপ ও সনাতন গোস্বামীর সার্থক উত্তরসূরী ছিলেন তিনি, আজ শুনবো জীব গোস্বামীর কাহিনী। অনেকেই জানেন না যে এই জীব গোস্বামীর প্রভাবেই বৃন্দাবনে মৃগয়া নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়। বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনের পথে বৈষ্ণব সমাজকে সুসংবদ্ধ করতে যে জীব গোস্বামীর অবদান অনস্বীকার্য ,  এক মারাত্মক ভুলের জন্য তাকেই আশ্রম থেকে বিতাড়িত করেছিলেন জীব গোস্বামীর গুরু শ্রীরূপ গোস্বামী! 


জীব গোস্বামী ছিলেন রূপ ও সনাতন গোস্বামীর ছোট ভাই অনুপম গোস্বামীর ছেলে। ১৫১১ খ্রিঃ জীব গোস্বামীর জন্ম হয়। বিধবা মায়ের নয়নের মনি ছিলেন জীব গোস্বামী। ছোট থেকে মায়ের মুখে খুড়োদের ভক্তি সাধনার কথা শুনে জীবের মনেও ভক্তি রস অঙ্কুরিত হয়েছিল। তাই কৃষ্ণ লীলার অনুকরণে বালক সাথীদের সঙ্গে তিনি খেলা করতেন এবং মনের আনন্দে নিজেই তৈরি করতেন কৃষ্ণ ও বলরামের যুগল মূর্তি, এরপর সেই মূর্তি তিলক-চন্দন ও ফুলমালা দিয়ে সাজিয়ে ভাবে বিভোর হয়ে যেত সে। 


আসলে মহাপ্রভু যখন রামকেলিতে এসে রূপ ও সনাতনকে দর্শন দান করেন তখন অনুপম পত্নী ও তার শিশু পুত্রকে নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন এবং মহাপ্রভুর চরণে শিশুপুত্রকে শুইয়ে দিয়েছিলেন। মহাপ্রভু তখন স্নেহ ভরে শিশুটির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। আজ কিশোর জীবের অন্তরে এমন বৈরাগ্য দেখে মায়ের মন অজানা আশঙ্কায় ভরে ওঠে। এরপর মায়ের আশঙ্কা সত্যি করে মাত্র ২০ বছর বয়সে  ত্যাগ ব্রতে দীক্ষিত হয়ে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন শ্রীজীব গোস্বামী আর কোনদিনও সংসারে ফিরেনি তিনি। ‌


নবদ্বীপে পৌঁছে তিনি আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠেন, সেখানে শ্রীবাস পন্ডিতের গৃহে  নিত্যানন্দ প্রভুকে দেখতে পেয়ে তার চরণে লুটিয়ে পড়েন। প্রভু নিত্যানন্দ তাকে আশীর্বাদ করেন এবং মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের স্মৃতি জড়িত স্থানগুলো তাকে ঘুরে ঘুরে দেখান। শ্রী চৈতন্যের শেষ স্মৃতিচিহ্ন জড়িত নীলাচল দেখবার স্বাদ তখন প্রবল হয়ে ওঠে শ্রীজীবের মনে। কিন্তু নিত্যানন্দ তাকে যেতে দেন না, নিষেধ করে বলেন,“ না জীব নীলাচলে গিয়ে ভাবোন্মত্ত  হয়ে বসে থাকলে তোমার চলবে না, তুমি যাও বৃন্দাবনে। মহাপ্রভু তোমাদের বংশকেই এই বৃন্দাবন ধামের ভার দিয়ে গিয়েছেন। সেখানে গিয়ে তুমি ভক্তি ধর্ম প্রচারে ব্রতী হও। তার আগে কাশীতে গিয়ে সেখান থেকে মধুসূদন বাচস্পতির কাছ থেকে নাও বেদান্তের পাঠ।”


জীব তাই করলেন, নিত্যানন্দ প্রভুর কথা অনুযায়ী  শাস্ত্র অধ্যায়ন শেষ করে তিনি পৌঁছে গেলেন বৃন্দাবনে সেখানে তার দুই পিতৃব্য  সনাতন ও রূপ গোস্বামীর প্রভাব। রূপ গোস্বামী নিজে জীব গোস্বামীকে বৈষ্ণব মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন। ভারতের নানা অঞ্চল থেকে সেই সময় পন্ডিতরা ব্রজ মন্ডলে আসতেন। রূপ গোস্বামী শাস্ত্রবিদ, বৈষ্ণব আচার্যদের নেতা। তাই সকলেই তার সামনে এসে দাঁড়াতেন তর্ক করার অভিপ্রায়ে, রূপ গোস্বামী যশের কাঙাল ছিলেন না, বৈষ্ণব সুলভ বিনয় ছিল তার চরিত্রের আদর্শ তাই  কেউ তর্ক বিচারে তাকে আহবান করলেও তিনি সাড়া না দিয়ে জয়পত্র লিখে দিতেন। 

 

গুরুগত প্রাণ শ্রীজীবের এটা সহ্য হত না, কাজেই সুযোগ পেলেই পডিতদের সঙ্গে তর্ক করে তাদের পরাস্ত করতেন তিনি। এইভাবে একদিন দাক্ষিণাত্যের বিষ্ণু স্বামী সম্প্রদায়ের প্রবর্তক মহা পন্ডিত বল্লভ ভট্ট যখন বৃন্দাবনে এসে রূপ গোস্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন তখন শ্রীজীব‌ও এখানে উপস্থিত ছিলেন, শ্রী রূপ রীতিমতো বিনয়ের সঙ্গে তার লেখা ভক্তিরসামৃত থেকে কিছুটা পড়ে শোনালেন বল্লভ আচার্যকে। ইনি মঙ্গলাচরণ শ্লোকে কিছু খুঁত ধরলেন। 

 

শ্রীরূপ কোনরকম তর্ক না করে বল্লভ আচার্যের কথা মেনে নিয়ে তাকে লেখা সংশোধন করার অনুরোধ জানিয়ে স্নানে চলে গেলেন। শ্রীজীব তখন বুঝলেন এই সুযোগ, গুরুর সামনে তিনি মুখ খুলতে পারেন নি কিন্তু এবার তিনি শাস্ত্রের নানা যুক্তি ও প্রমাণ সহযোগী দেখিয়ে দিলেন শ্রী রূপের রচনায় কোনও ভুল হয়নি, ভুল হয়েছে বল্লভ আচার্যের। হেরে গিয়েও বল্লভ বিস্মিত হলেন তরুণ যুবক শ্রী জীবের পান্ডিত্য দেখে। কুটির থেকে বেরিয়ে আসার সময় যখন তার শ্রী রূপ গোস্বামী সঙ্গে দেখা হলো তখন তিনি বললেন ,“ আপনার লেখা আর সংশোধন করতে হলো না আমাকে, আমারই ভুল হয়েছিল আর সেই ভুলটা ধরিয়ে দিল ওই প্রতিভাবান যুবকটি” এ কথা শুনে রূপ গোস্বামী অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেন শ্রীজীবের প্রতি। বৈষ্ণব সুলভ বিনয় ও দৈন্য যার নেই সে কিছুতেই আদর্শ বৈষ্ণব হতে পারে না।


বৈষ্ণব নেতা বল্লভ ভট্টকে পরাজিত করায় রূপ গোস্বামী রেগে গিয়ে শ্রীজীবকে বিতাড়িত করলেন। এরপর এক গভীর অরণ্যে আশ্রয় নিয়ে শ্রী জীব কঠোর সাধন-ভজনা শুরু করেন এবং সাধনের শেষে তার এক জ্যোতির্ময় রূপ হয় যা দেখে গুরু রূপ গোস্বামী আনন্দে এগিয়ে আসেন এবং তাকে একটি পৃথক-বিগ্রহ সেবার ব্যবস্থা করে দেন এই বিগ্রহের নাম শ্রী রাধা দামোদর। শ্রীজীব গোস্বামীর অসামান্য ভক্তির পরিচয় পেয়ে দিল্লি থেকে বাদশা অর্থাৎ সম্রাট আকবর ছুটে এসেছিলেন তার কিছু মনোবাসনা  পূর্ণ করতে,  শ্রী জীব তখন বললেন , অনেকে বৃন্দাবনে বেড়াতে এসে বহু প্রাণী শিকার করে, এটা বন্ধ হলে বৈষ্ণবেরা সন্তুষ্ট হবেন। আকবর তারপরেই আকবর আদেশ জারি করলেন বৃন্দাবনে মৃগয়া করা চলবে না। ‌ 


সনাতন গোস্বামী বৃদ্ধ ও অশুক্ত হয়ে পড়লে প্রতিদিন গোবর্ধন পরিক্রমা করতে পারেন না তাই তার আরাধ্য ভগবান গোবিন্দ  কৃপা করে তার কাছে আবির্ভূত হয়ে চরণপাহাড়ী শিলা প্রদান করেন, তখন সনাতন এই শিলাখণ্ডকেই পরিক্রমা করতেন। সনাতন গোস্বামীর দেহত্যাগের পর এই শিলাটি নবনির্মিত মন্দিরে স্থাপন করেন জীব গোস্বামী ও সেই মন্দিরের একটি প্রকোষ্ঠে জীব গোস্বামী গড়ে তোলেন তার বিরাট গ্রন্থশালা। বৈষ্ণব সাহিত্যের অমূল্য গ্রন্থরাজি তিনি সংগ্রহ করতে থাকেন। ক্রম সন্দর্ভ,ষট সন্দর্ভ, মাধব মহোৎসব ইত্যাদি ভক্তি শাস্ত্রের সংকলন প্রচার ও নব প্রচারিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের বিস্তার এরকম অনেক কিছু জীব গোস্বামী নিজের জীবনে করে ছিলেন। রাজা মানসিংহ তার‌ই প্রেরণায় নির্মাণ করে দেন গোবিন্দজীর বিরাট মন্দির বৈষ্ণব সমাজকে সুসংবদ্ধ করে তুলতে রূপ গোস্বামীর অবদান অনেক। ১৫৯৬ সালে রূপ গোস্বামী তার নিত্য লীলা সম্পূর্ণ করে চলে যান গোলকধামে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...