গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, যখন যখন অনাচার বৃদ্ধি পাবে, তখন সৎ পুরুষদের উদ্ধার করবার জন্য ও অধর্মীদের বিনাশ করবার জন্য আমি অবতীর্ণ হব। এই কথাকে সত্য প্রমাণ করতে বারংবার অবতরিত হয়েছেন ভগবান। শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু হলেন স্বয়ং ভগবান, শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু ভগবানের মাহাত্ম্য প্রচার ও পাপীদের উদ্ধারের জন্য এসেছিলেন এই পৃথিবীতে। হরিনাম গানের মাহাত্ম্য প্রচার করে জগৎবাসীকে উদ্ধার করেছেন তিনি, উদ্ধার করেছেন সনাতন হিন্দুধর্মকে।
স্বয়ং ভগবান শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকেও কিন্তু দীক্ষা গ্রহণ করতে হয়েছিল। তিনি দীক্ষাগুরু রূপে গ্রহণ করেছিলেন শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরীকে। ঈশ্বরপুরীর জন্মভূমি ছিল কুমারহট্ট। শ্রীচৈতন্য ও ঈশ্বরপুরীর পায়ের ধুলো লেগে সেই কুমারহট্ট হয়ে ওঠে পরম পবিত্র। শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরী জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ১৪৭৮ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম জীবনে সংস্কৃত বিদ্যা অর্জন করে অল্প দিনের মধ্যে ভক্তি শাস্ত্রে গভীর পাণ্ডিত্য লাভ করেন তিনি।
এই ঈশ্বরপুরীর জীবন ছিল ভীষণ বৈচিত্র্যময়। তিনি দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন শ্রীপাদ মাধবেন্দ্রপুরীর কাছে। গুরুদেবের অভয় চরণে আশ্রয় নিয়ে তিনি তাঁর সেবা কার্যে ব্রতী হয়ে ছিলেন। শ্রীপাদ মাধবেন্দ্রপুরী গিরি গোবর্ধনে গোপালের সেবায় রত ছিলেন, তখন একদিন তাঁর প্রতি গোপালের আদেশ হয়, নীলাচল থেকে মলয়ের চন্দন এনে তার গায়ে লেপন করতে হবে। এই আদেশটি বড় অদ্ভুতভাবে এসেছিল মাধবেন্দ্রপুরীর কাছে। একদিন স্বপ্নে তাকে নির্দেশ দেন গোপাল বললেন,“ খুব ঘটা করে তো আমার নিত্য পুজো করছ পুরী গোঁসাই! এদিকে প্রচন্ড গরমে আমি যে আর তিষ্টতে পারছি না। দেহে অসহ্য জ্বালা! এ জ্বালা দূর করার জন্য কী ব্যবস্থা করেছ শুনি?”
নিজের আরাধ্যর কণ্ঠে এ কেমন অভিযোগ? নিখিল মানুষের সুখ দুঃখ যিনি নিবারণ করছেন তার শরীরে এই যন্ত্রণা!
অবাক হয়ে যান মাধবেন্দ্রপুরী,কী করবেন তিনি? কীভাবে তাঁর আরাধ্যের যন্ত্রণা উপশম করবেন? এইসময় তার উপর গোপালের আদেশ বর্ষিত হল, আর কাউকে না পাঠিয়ে নিজে নীলাচলে গিয়ে নিয়ে এসো সেই চন্দন।
প্রভুর আদেশ কী আর লংঘন করা যায়! বৃন্দাবন ত্যাগ করে মাধবেন্দ্রপুরী নীলাচলের পথ ধরলেন! তখনকার দিনে গৌড় হয়ে যেতে হত নীলাচলে! সেই পথে যাত্রা করে শান্তিপুরে এলেন পুরী গোঁসাই! তার প্রিয় ছাত্রদল যাদের সঙ্গে মিলিত হলেন তিনি এক শুভ লগ্নে! পুরী গোঁসাই এর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করলেন অদৈত্যআচার্য। ভক্তি ধর্মের ক্ষেত্রে তৈরি হল এক বিরাট বনস্পতির সম্ভাবনা! শান্তিপুর ও নবদ্বীপে কিছুদিন কাটিয়ে মাধবেন্দ্র এগিয়ে চললেন উড়িষ্যার পথে উপস্থিত হলেন রেমুনায়।
মলয়ের চন্দন নিয়ে রেমুনায় শ্রী ক্ষীরচোরা গোপীনাথের স্থানে অবস্থানকালে মাধবেন্দ্রপুরী অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঈশ্বরপুরী তখন গুরুদেবের এই অসুস্থতায় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হন। তখন গুরুদেবের সেবা শুশ্রুষা করতে শুরু করলেন তিনি। প্রিয় শিষ্যের এই নিঃস্বার্থ সেবায় অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন মাধবেন্দ্রপুরী। তার সমস্ত কৃষ্ণ প্রেম তিনি উজার করে দেন ঈশ্বর পুরীকে।
কৃষ্ণ প্রেমে ঈশ্বরপুরী তখন হয়ে ওঠেন শক্তিধর। গুরুর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ঈশ্বর পুরী অক্লান্ত সেবা করেছিলেন শ্রীপাদ মাধবেন্দ্রপুরীকে। এরপর গুরু লীলা সংবরণ করলে ঈশ্বরপুরী আহার, নিদ্রা প্রায় ভুলে যান!শোক সংবরণের জন্য তিনি উন্মত্ত অবস্থায় নানা দেশে পরিভ্রমণ করতে থাকেন!
গয়াধামে বিখ্যাত বিষ্ণুপদপদ্ম মন্দির গর্ভে উপস্থিত রয়েছেন শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরী। সেখানে এসেছেন নিমাই পণ্ডিত পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে পিন্ড দান করবার জন্য। বিষ্ণুপাদ পদ্ম দর্শনে ভাবাবিষ্ট হলেন নিমাই!ভাবলেন অনিত্য সংসার সমুদ্রে বিক্ষিপ্ত ঝঞ্ঝার মধ্যে চির ভাসমান এই চরণপদ্মই হল একমাত্র সত্য ও অক্ষয় সম্পদ। নিমাই পন্ডিতের এই ভাবন্ময় অবস্থা দেখে চমকে গেলেন ঈশ্বরপুরী! এগিয়ে এলেন তিনি, চিনতে পারলেন নবদ্বীপে এঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।
নিমাই পন্ডিত ও এই মহাসাধককে দর্শন করে পুলকিত চিত্তে তাকে প্রণাম করে বললেন,“ আমার কী সৌভাগ্য গয়াধামে বিষ্ণুপাদপদ্ম দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে পরম বিষ্ণু ভক্তের দর্শন পেলাম। আমাকে দয়া করে দীক্ষা দান করে কৄতার্থ্য করুন।”
গয়াধামে শ্রীচৈতন্যদেব শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরীর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। শুভক্ষণে ঈশ্বর পুরী নিমাইয়ের কানে মন্ত্র দিলেন ও আলিঙ্গন করলেন নিমাই পণ্ডিতকে! সেখানেই ঈশ্বর পুরীর সাথে নিমাইয়ের শেষ দেখা!এরপর সন্ন্যাস গ্রহণ করে নিমাই দক্ষিণ দেশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন। দুইবছর ধরে তিনি দক্ষিণ দেশে ভ্রমণ করেন আর তারপর আবার প্রভু নীলাচলে ফিরে আসেন। নীলাচলে তিন মাস কাটিয়ে শ্রীধাম বৃন্দাবন যাত্রার উদ্দেশ্যে গৌড় দেশের দিকে যাত্রা করেন। এরপর ভুবনেশ্বর, পানহাটি হয়ে নিমাই শান্তিপুরের পথে রওনা হন।
গৌরাঙ্গ সুন্দর এসে পৌঁছলেন কুমারহট্টে। সেই ভূমিকে প্রণাম করে গৌরাঙ্গ বললেন,“ এই মাটি আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় যেহেতু গুরুদেবের জন্মস্থান এই কুমারহট্ট।” এর কিছুকাল আগেই শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরী দেহ রক্ষা করেছেন শ্রীচৈতন্যদেবের এলেন তার জন্মভিটা দর্শনে! জন্মভিটায় এসেই তিনি শ্রীপাদের বিচ্ছেদে কাতর হয়ে পড়লেন অবোধ বালকের মতো! ‘হা গুরুদেব হা গুরুদেব’ বলতে বলতে শ্রীপাদের চরণধুলি লেগে থাকা কুমারহট্টের পবিত্র মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলেন তারপর নিজের বহির্ভাসে বেঁধে নিলেন গুরুর জন্ম ভিটের মাটি। প্রভুকে শ্রীপাদের জন্মভিটার মাটি নিতে দেখে লক্ষ লক্ষ ভক্ত পার্ষদ সেখান থেকে এক ধুলি মাটি গ্রহণ করতে লাগলেন এইভাবে মাটি নেওয়ার ফলে সৃষ্টি হলো একটি ছোট ডোবা, সেই ডোবা ‘শ্রীচৈতন্য ডোবা’ নামে পরিচিত। মহাপ্রভুর চরণধূলি ধন্য কুমারহট্ট এই ভাবেই তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সেদিনের কুমারহট্ট আজ হালিশহর নামে পরিচিত তবুও কুমার হট্টের নাম বৈষ্ণব সমাজ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গেই গ্রহণ করে আজও।