আজ বলব পরম বৈষ্ণব ভক্ত রায় রামানন্দের কথা। গোদাবরী নদীতে স্নান করে চৈতন্য মহাপ্রভু কৃষ্ণ নাম কীর্তন করছেন, এমন সময় দোলায় করে সেখানে এক রাজ পুরুষ এলেন। ভৃত্য,রক্ষী,বাদ্যকর ও বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিলো তার সঙ্গে। প্রভুর অন্তর উদ্বেল হয়ে উঠল রাজ পুরুষটির সাথে আলাপ করার জন্য। অন্যদিকে রায় রামানন্দেরও তো সেই একই অবস্থা, অবাক হয়ে তিনি ভাবতে থাকলেন, কে এই সুদর্শন সন্ন্যাসী? তিনি নিজেই এগিয়ে এলেন সন্ন্যাসীর দিকে। পরস্পরের পরিচয় পেয়ে দুজনে একে অপরকে আলিঙ্গন করলেন। এই রাজপুত্রই হলেন রায় রামানন্দ। প্রভু বললেন, দাক্ষিণাত্য পরিভ্রমণে আসার সময় বাসুদেব সার্বভৌম আমায় বলেছিলেন,“ তোমার সঙ্গে একবার যেন অবশ্যই মিলিত হই, আজ তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে আনন্দিত হলাম।”
রামানন্দ রায় উত্তর দিলেন,“সার্বভৌম মশায় আমায় অত্যন্ত কৃপা করেন, নইলে আমার মত দীন ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য কখনো আপনার মত মহাত্মাকে অনুরোধ করেন? আমি এক রাজ ভৃত্য, আপনি সাক্ষাৎ নারায়ন। আপনার দর্শনে আমার জীবন আজ ধন্য।” শ্রী চৈতন্য বললেন,“তুমি পরম ভাগবত দেখো রামানন্দ দেখো তোমার সংস্পর্শে আমার শরীর পুলকিত হচ্ছে. সার্বভৌম অতি বিচক্ষণ ব্যক্তি আমার হৃদয়ের যাতে শোধন হয় সেজন্যই তোমার কাছে আমায় পাঠিয়েছেন।”
প্রথম সাক্ষাতের পর থেকেই রায় রামানন্দ মহাপ্রভুর সাথে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ করার জন্য উদ্বেল হয়ে উঠলেন। সেদিন সন্ধ্যায় আবার মহাপ্রভুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন রায় রামানন্দ। উভয়ের মধ্যে বৈষ্ণব তত্ত্বকথা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হল। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু রামানন্দকে জিজ্ঞেস করলেন, বলো কোন সাধন পন্থার মাধ্যমে সেই পরম বস্তুর নিকট পৌঁছানো যায়? রামানন্দের সহজ উত্তর,“সখী বিনু এই লীলায় নাহি অন্যের গতি।” অর্থাৎ গোপীভাবে কৃষ্ণ ভজনা করলে তবেই ব্রজ গোপী নন্দন সাক্ষাৎ শ্রী ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়া যায়। এভাবেই বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে ঘন্টার পর ঘন্টা কৃষ্ণ তত্ত্ব আলোচনায় কেটে গেলো দুজনেই কৃষ্ণ তত্ত্ব আলোচনা করতে করতে ভাবে বিভোর হয়ে উঠলেন। একে অপরকে আলিঙ্গন করলেন, দুজনের হয়ে উঠল ভাবোন্মত্ত অবস্থা। সে রাত্রি দুজনে মিলে কৃষ্ণ কথা বলেই কাটাতে থাকলেন।
মহাপ্রভুর পূর্ণ সঙ্গের লোভ রাম রায় কিন্তু ছাড়তে পারলেন না, তিনি বিনীতভাবে নিজের মনের ইচ্ছার কথা রায় রামানন্দকে জানালেন। তিনি মহাপ্রভুকে বললেন, প্রভু তুমি যেচে আমায় কৃপা করতে এসেছো, তাহলে এখানে দিন দশেক থেকে যাও। তোমার শ্রী মুখে কৃষ্ণ তত্ত্বের ব্যাখ্যা শুনে আমার হৃদয় মন জুড়িয়ে যাক। মহাপ্রভু উত্তর দিলেন, রাম রায় আমি এসেছি তোমার মত কৃষ্ণ ভক্তের মুখে লীলা মাহাত্ম্য শুনে জীবন ধন্য করব বলে। দশ দিনের কথা কি বলছ? তোমাকে আমি আজীবনের সঙ্গী করতে চাই। বিষয়কর্ম ত্যাগ করে তুমি নীলাচলে চলে এসো। আমিও তীর্থ পরিক্রমা শেষ করে সেখানে তোমার সঙ্গে মিলিত হব। অহোরাত্র কৃষ্ণ কথামৃত পাণ করে দুজনে পরিতৃপ্ত হবো।”
প্রভু এবং রায় রামানন্দের এই মধুর মিলন কাহিনীকে খুব সুন্দর ভাবেই তুলে ধরা হয়েছে ভক্ত স্বরূপ দামোদরের চৈতন্য কড়চায়। উড়িষ্যার প্রতাপ রুদ্রের বিশ্বস্ত সচিব ছিলেন ভবানন্দ রায়ের পুত্র রায় রামানন্দ। তার জন্ম হয়েছিল ১৪৭০ খ্রিস্টাব্দে। অল্প বয়সে রামানন্দ উড়িষ্যা সরকারের অধীনে রাজকর্ম গ্রহণ করেন পরে কর্মদক্ষতার গুণে রাজমেহেন্দ্রী পরগনার শাসনকর্তা হন। শ্রী চৈতন্যের দর্শন পাওয়ার পর রাম রায়ের জীবনে ঘটলো চূড়ান্ত পরিবর্তন, বিষয়কর্মে ঘেন্না ধরে গেল তার। তারপর প্রভু নিজে তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন নীলাচলে গিয়ে বসবাস করতে, সেখানেই প্রভু তার সঙ্গে মিলিত হবেন । প্রভুর আদেশ কি আর অমান্য করতে পারেন রায় রামানন্দ? রাজা প্রতাপ রুদ্রকে আপন মনোবাসনা জানাতে রাজা তাকে আনন্দের সাথে শুধু যে সম্মতি দিলেন তাই নয় রাজ কোষাগার থেকে তিনি যে বেতন পেতেন তা নীলাচলে বাসকালেও পাবেন বলে নির্দেশ দিলেন।
দাক্ষিণাত্য পরিভ্রমণ করে মহাপ্রভু নীলাচলে ফিরে এসেছেন, রামানন্দ রায় ও প্রভুর সঙ্গে মিলিত হলেন। বৈষ্ণব ভক্ত প্রদুম্ন মিশ্রকে প্রভু পাঠিয়েছেন রাম রায়ের কাছে কৃষ্ণ কথা শুনবেন বলে, মিশ্র গিয়ে শুনলেন রামরাই তার জগন্নাথবল্লভম নাটকের অভিনয় উপলক্ষে মহড়া দিতে ব্যস্ত। দুই কিশোরী দেবদাসী কে নৃত্য গীতে তালিম দিচ্ছেন এবং তাদের নিজের হাতে স্নান করিয়ে শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছেন এই কথা শুনে প্রদুম্ন মিশ্র ফিরে এলেন, তার অন্তরে এক মহা সংশয় উপস্থিত হল। বৈষ্ণবদের মধ্যে যেখানে কামনা বাসনার লেশমাত্র থাকে না সেখানে যতই কিশোরী হোক দুই তরুণীকে এভাবে স্নান করিয়ে বস্ত্র করিয়ে দেওয়া, ব্যাপারটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। মহাপ্রভু তাকে নির্দেশ দিয়েছেন কিন্তু তার মন কিছুতেই সায় দিল না। তিনি যেন পরম ধোকায় পড়লেন। তিনি ভাবলেন এ কেমন বৈষ্ণব? কোন উচ্চকোটির বৈষ্ণবের পক্ষে এটা উচিত কার্য? প্রদুম্ন মিশ্র ফিরে এলেন ও মহা প্রভুকে সব কথা জানালেন। মহাপ্রভু রায় রামানন্দ সম্পর্কে যা বললেন, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। মহাপ্রভুকে সব জানাতেই চৈতন্যদেব বললেন, রামানন্দ রায় সমস্ত চিত্ত বিকারের ঊর্ধ্বে, তুমি তার কাছে গিয়ে এই কৃষ্ণ কথা শ্রবন করো। প্রদুম্ন মিশ্রকে মহাপ্রভু জানালেন যে, ব্রজ রস সাধনার সিদ্ধ পুরুষ এই রামানন্দ রায়, রাধাকৃষ্ণের লীলা সাধনে সদায় ব্যস্ত। তার মধ্যে প্রাকৃত জনের মানসিক বিকার বা চাঞ্চল্য কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই ছিলেন রায় রামানন্দ, যার চারিত্রিক মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছিলেন স্বয়ং চৈতন্য মহাপ্রভু। ব্রজ রস সাধনার তত্ত্ব বর্ণনায় রাম রায় ছিলেন অদ্বিতীয়। দীর্ঘ ১৮ বছর নীলাচলে মহাপ্রভুর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ছিলেন তিনি, সঙ্গে ছিলেন স্বরূপ দামোদর।১৫৩৪ সালে রায় রামানন্দের তিরোভাব ঘটলে ভক্তি জগতে এক হাহাকারের তৈরি হয়।