চৈতন্য মহাপ্রভু কী উপহার দিয়েছিলেন ভক্ত রঘুনাথ ভট্টকে?

পদ্মার ওপারে পূর্ববঙ্গের রামপুর গ্রামে বাস করতেন এক ব্রাহ্মণ, তাঁর নাম তপন মিশ্র। নিমাই পণ্ডিত সেই গ্রামে গিয়ে ব্রাহ্মণকে নির্দেশ দেন কাশীধামে গিয়ে একসঙ্গে বসবাস করতে। নিমাই পণ্ডিতের কথা শুনে তপন মিশ্র কাশীতে বাস করতে শুরু করেন সপরিবারে এবং সেখানেই ১৫০৫ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন তাঁর পুত্র রঘুনাথ মিশ্র। এরপর কেটে যায় দীর্ঘ আট থেকে নয় বছর। শ্রী চৈতন্য কাশীধামে আসেন এবং দু মাস তপন মিশ্রের বাড়িতে থাকেন। তপন মিশ্রের সঙ্গে সঙ্গে বালক রঘুনাথও সেই দুইমাস মহাপ্রভুর সেবা করতে থাকেন। এরপর মহাপ্রভু চলে যান নীলাচলে। বালক রঘুনাথ লেখাপড়া করলেও মহাপ্রভুর প্রতি ছোট থেকেই তার আকর্ষণ তৈরি হয়। সব রকম কাজের মাঝে মহাপ্রভুকে দেখতে থাকে সে। মহাপ্রভুর দিব্যকান্তি রূপ তাকে আকর্ষণ করে বারবার।

ধীরে ধীরে এই আধ্যাত্মিক মন নিয়েই বড় হয় রঘুনাথ,যুবক থেকে বড় পন্ডিত হয়ে ওঠে সে। কিন্তু তার মনের মধ্যে কোনও এক অদৃশ্য মহাপুরুষ যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে শুরু করে। শ্রীধাম পুরীক্ষেত্রে রথযাত্রা হচ্ছে শুনে বারাণসী থেকে পায়ে হেঁটে রঘুনাথ ভট্ট উপস্থিত হন পুরীতে। সেখানে গিয়ে তিনি দেখা পান মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের। দেড় যুগ পরে তাদের দেখা অথচ দেখামাত্রই প্রভু তাকে চিনতে পারেন এবং একে অপরকে তারা আলিঙ্গন করেন। তারপরের দিনগুলো স্বাভাবিকভাবেই পরমানন্দে কাটাতে থাকেন তারা দুজনে।

রঘুনাথ ভট্ট প্রতিদিন মহাপ্রভুকে দর্শন করেন ও তার মুখ থেকে নানান রকম শাস্ত্রীয় উপদেশ শোনেন এবং নানান সুস্বাদু অন্ন ব্যঞ্জন রান্না করে মহাপ্রভুকে পরিতুষ্ট সহকারে খাওয়ান। এইভাবে আট মাস কাটার পর মহাপ্রভু তাকে কিছু আদেশ দেন, যে আদেশগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন তিনি। মহাপ্রভু রঘুনাথ ভট্ট কে আদেশ দিয়েছিলেন গৃহে ফিরে পিতা-মাতার সেবা করতে। এছাড়া একই সাথে তিনি আরও তিনটি আদেশ দেন রঘুনাথ ভট্টকে, বিবাহ করবে না, বৈষ্ণব স্থানে ভাগবত কথা অধ্যয়ণ করো, আবার নীলাচলে এসো।

এরপর মহাপ্রভু নিজের গলার মালা খুলে পরিয়ে দিলেন রঘুনাথকে। সেই মুহূর্তে রঘুনাথের চোখে জল চলে এলো এবং চোখের জল এসে নীলাচল থেকে বিদায় নিলেন তিনি। মহাপ্রভুর নির্দেশ মত তিনি এলেন বারাণসীতে, এসে মহাপ্রভুর চারটে নির্দেশে পালন করলেন নিষ্ঠা সহকারে। মা বাবার সেবা করতে লাগলেন রঘুনাথ , ভাগবত পাঠ করতে লাগলেন ও তার বাবা-মা প্রয়াত হলে তিনি মহাপ্রভুর শেষ নির্দেশ
'আরও একবার এসো নীলাচলে' স্মরণ করে

মহাপ্রভু্র সঙ্গে আবারও মিলন হল রঘুনাথের। প্রভু তার নিত্য সঙ্গদানে ধন্য করলেন রঘুনাথ ভট্টকে। রঘুনাথ যেমন দেখতে সুন্দর ছিলেন, তেমনি তার গলার স্বর ছিল অপূর্ব। এরপর পুরো ৮ মাস শ্রীচৈতন্য তার ভক্তকে নিজের কাছে রেখে দিলেন এবং তাকে ভাগবত সাধনার পুণ্য অধিকারী করে তুললেন। মহাপ্রভু বুঝেছিলেন যে রঘুনাথের মনটি খাঁটি সোনায় তৈরি, তাতে কোন খাদ নেই। তাই ভাগবত সাধনার প্রস্তুতি পর্ব সমাপ্ত হলে একবার মহাপ্রভু রঘুনাথকে ডেকে বললেন, তোমার নীলাচলে অবস্থানের আর প্রয়োজন নেই, এবার যাও বৃন্দাবনে, সেখানে আমার পরম ভক্ত রূপ আর সনাতন আছে। তাদের কাছে গিয়ে থাকো , ভাগবত পাঠ করো আর কৃষ্ণ কথা শ্রবণ কর, কৃষ্ণ নাম কীর্তন করো তবেই তোমার কৃষ্ণ প্রাপ্তি হবে। এরপর জগন্নাথদেবের চৌদ্দো হাত লম্বা তুলসী মালা যা মহাপ্রভু এক মহোৎসবে পেয়েছিলেন, সেই মালা তিনি রঘুনাথকে দিলেন। সেই মালা মাথায় করে বৃন্দাবনে চলে গেলেন রঘুনাথ ভট্ট ও রূপ-সনাতনের আশ্রয় থেকে তিনি কৃষ্ণ নাম জপ করতে থাকলেন আর তার কন্ঠে ভাগবত পাঠ শুনতে শুনতে শ্রোতাদের নয়ন চোখের জলে ভেসে গেল।

বরাবর আত্মপ্রচার বিমুখ মানুষ ছিলেন রঘুনাথ ভট্ট। পান্ডিত্য দেখাবার কোনও লোভ তাঁর মধ্যে ছিল না। তাঁর কাছে যদি কেউ দীক্ষা গ্রহণ করতে আসতো তাহলেও তিনি শিষ্যত্ব করতে চাইতেন না কিন্তু রূপ সনাতনের নির্দেশে তাকে দীক্ষা দিতেই হত, আসলে রূপ সনাতনের নির্দেশ মানলেও তার মন সবসময় ভগবানের চরণেই পড়ে থাকত। নীলাচলে যেমন গদাধর পন্ডিত নিজে কেঁদে কেঁদে ভাগবত পাঠ করে শোনাতেন ও সকলকে কাঁদাতেন ঠিক সেই রকম বৃন্দাবনেও একই রকম ভাবে প্রাণ কাঁদানো মন ভরানো ভাগবত পাঠক ছিলেন রঘুনাথ ভট্ট। তিনি ছিলেন মহা বিনয়ী। গোবিন্দ মন্দিরে ভাগবত পাঠ করতেন তিনি, সকল মানুষকে বিশ্বাস করতেন সরল মনে আর পরনিন্দা, পরচর্চা করতেন না মোটেও। এই অবস্থায় ভগবানের নাম কীর্তন করতে করতে মাত্র অনুমান ৪৯ বছর বয়সে ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে মহাসমাধিতে লীন হয়ে যান তিনি। তার মহাপ্রয়াণে শোকে নিমজ্জিত হয় ভক্তকুল।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...