দস্যু সর্দার থেকে ভক্তে পরিণত হয়েছিলেন নামদেব

দস্যু রত্নাকর পরমসাধক বাল্মিকীতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন, এক তীব্র অনুশোচনার দ্বারা, তিনি যখন বুঝতে পেরেছিলেন তার স্ত্রী, বাবা, মায়ের মুখে অন্ন তুলে দিতে তিনি যে পাপ কার্য করছেন সেই পাপ কার্যের ভার তার পরিবারের কেউ নেবে ন, তাকে একাই বহন করতে হবে! তখন তার চিত্তশুদ্ধি হয়েছিল, এর পর মরা মরা জপতে জপতে রাম নাম উচ্চারিত হয় তার মুখে, তারপর তিনি পরিণত হন পরম সাধক বাল্মিকীতে। এই বাল্মিকীর কথা আমরা যেমন জানি, তেমনভাবে কিন্তু আমরা নাম দেবের কথা জানি না। কিন্তু শুনলে অবাক হয়ে যাবেন যে, বাল্মিকীর মত নাম দেবও দস্যু সর্দার থেকে হয়ে উঠেছিলেন পরম বৈষ্ণব সাধক নামদেব। কীভাবে হয়েছিলো তার অন্তরের পরিবর্তন?

অম্বোধিয়ার দেবী মন্দিরের উদ্দেশ্যে এক দস্যু সর্দার ঘোড়ায় চড়ে আসছিলেন। হঠাৎ মন্দিরের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালেন তিনি। থমকে দাঁড়ানোর কারণ ছিল একটি দৃশ্য! যে দৃশ্য দেখে তার মনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছিলো আর সেই প্রশ্নের উত্তর তার অন্তর পরিবর্তন করেছিল। দস্যু সর্দার দেখলেন গাছের নীচে এক বিধবা , তার কোলে এক শিশু সন্তান, দুজনেই কাঁদছে। দস্যু সর্দার তখন ঘোড়া থেকে নেমে জিজ্ঞেস করলেন,“ তোমার ছেলে এত কাঁদছে কেন? তোমারই বা এত কান্নার কারণ কী ? বিধবা রমণী তখন উত্তর দিলেন,“ একমাস আগে পোধনার জঙ্গলে ৮৪ জন সৈনিকের সাথে আমার স্বামী ও এক ডাকাত দলের হাতে মারা যায় সেই থেকে আমার কপাল ভাঙ্গে। আত্মীয়-স্বজনরা চক্রান্ত করে আমাকে স্বামীর ভিটে থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। দুই দিন ধরে ছেলেটির পেটে কোন দানাপানি পড়ে নি তাই সে কাঁদছে। ছেলের কষ্ট দেখে আমি আর সহ্য করতে পারছি না।” বিধবা রমনীর কথা শুনে দস্যু সরদার থরথর করে কাঁপতে লাগলেন কারণ তিনি বুঝতে পারলেন এই কর্মকান্ড তার ই চালিত দস্যু দল করেছে অর্থাৎ এই রমণীর দুর্ভাগ্যের জন্য তিনিই দায়ী।

দস্যু সরদার তখনই ছুটে যান অম্বোধিয়ার মন্দিরে দেবী মূর্তির দিকে তাকিয়ে বিহ্বল ভাবে কী যেন ভাবেন? তারপর দেয়ালের গায়ে ঝোলানো খর্গ বসিয়ে দেন নিজের গলায়। রক্ত ছুটতে থাকে গলা থেকে, ছুটে আসেন মন্দিরের সকল পুরোহিত ও সেবকরা,তাকিয়ে দেখেন, ক্ষত তখন তেমন গভীর হয়নি। তাই অনুশোচনার আগুনে তিনি দগ্ধ হতে থাকেন,অম্বোধিয়া ছেড়ে এরপর দস্যু সর্দার বেরিয়ে পড়েন পন্ধারপুরের পথে। পথে তিনি কাঁদতে থাকেন, কোথায় তুমি কলুষহারী প্রভু? কাঁদতে কাঁদতে বিঠ্ঠল দেবের চরণ তলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই দসু সর্দার পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন ভক্ত শ্রেষ্ঠ নাম দেব।

১২৭০ সালে মহারাষ্ট্রের এক ক্ষুদ্র গ্রামে নরসিংহপুরে নামদেবের জন্ম হয়। তার পিতা দামাশেট ছিলেন একজন দরিদ্র দর্জি, ব্রাহ্মণ ও ভগবানের তার ভক্তি ছিল প্রবল, কিন্তু তার ছেলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে হয়ে ওঠেন দস্যু সরদার। ভগবানের লীলা লুকিয়ে ছিল এর পেছনে! দস্যু রত্নাকর যেমন বাল্মিকী হয়েছিলেন তেমনি নরসিংহপুরের দস্যু হয়ে উঠেছিলেন পরম বৈষ্ণব নাম দেব, সেই পন্ধারপুর ছিল মহারাষ্ট্রের দেওগিরি রাজ্যের অন্তর্গত। নামদেবের অভ্যুদয়কালে এই দেওগিরির রাষ্ট্র জীবনে দেখা দেয় বিষম দুর্যোগ। ১৩০৭ সালে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর সেনাপতি মালিক কাফুর এই রাজ্য আক্রমণ করেন, বাহিনীর আক্রমণে সমগ্র দেওগিরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, রাজা রামদেব রাও বন্দী হন, সবজায়গায় তৈরি হয় হাহাকার। এই ঘটনার তিন বছরের মধ্যে দেওগিরি রাজ্য দিল্লি সুলতানের হাতে চলে আসে।

এই দুর্যোগ ঘন দিনে নামদেবের পূণ্য ভাগবত জীবন আর মধুর নাম কীর্তন সাধারণ মানুষের জীবনে
নিয়ে আসে ভক্তির ধারা, মানুষের ক্ষতবিক্ষত মনে বুলিয়ে দেয় সান্তনার প্রলেপ। তার গানে তার ভক্তিমতায় মানুষের মনে সঞ্চারিত হয় নতুন শক্তি ও উদ্দীপনা। মহারাষ্ট্রের পথেঘাটে গীত হতে থাকে তার গাওয়া সুন্দর সংগীত। ভক্তদের উদ্দেশ্যে তিনি অজস্র পথ নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তার মধ্যে একটি পথনির্দেশনায় তিনি বলেছিলেন যে,“ তোমার বৃত্তি বা কর্ম যাই হোক প্রভুর দিকে লক্ষ্য রাখবে স্থির অচল । দেখনা বালক আকাশে ঘুরি ওড়ায় কিন্তু হাতে ধরা থাকে শক্ত ডুরি। চোখ দুটি তার নিবন্ধ ঘুড়ির দিকে, ব্যস্ততা নেই ডুরির জন্য। গুজরাটি কন্যাদের মাথায় সাজানো ঘড়ার ওপর ঘড়া, অনায়াস ভঙ্গিতে হাত দুলিয়ে চলেছে হেঁটে, কিন্তু মন রয়েছে ঘড়ার উপর। তেমনি কর্মের জালে জড়িয়ে থেকেও অনুধ্যান করতে পারো প্রভুর চরণ পদ্ম।”

মারাঠা অভঙ রচয়িতাদের মধ্যে সাধক জ্ঞানদেবের পরে নামদেবের নাম উঠে আসে।নামদেবের শিষ্য জনাবাঈ একটি অভঙে ভক্তি সাধনার মূল সুরটিকে তুলে লিখেছেন যে- “ভক্তির পথ নয়কো মোটেই সহজ। এক মুঠো প্রাণনাশী বিষ কিংবা এক তীক্ষ্ণ তরবারির ঝকঝকে ফলা যেমন- তেমনি দুর্গম পথ দিয়ে তোমাকে ঢুকতে হবে ভক্তির আনন্দলোকে।” গুরু নাম দেবের অলৌকিক শক্তির কথা উল্লেখ করে জনাবাঈ বলেছিলেন, একবার পন্ধারপুরে তুমুল বর্ষায় নদীর দুই কুল ছাপিয়ে ছুটে চলে আসে বন্যা। সকলে শঙ্কিত গোটা গ্রাম বুঝি ভেসে যাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে , শেষ হয়ে যাবে প্রভু বিঠোবাজির মন্দির। এই সংকট সময়ে নামদের এগিয়ে এসে শুরু করলেন অবিরাম নাম কীর্তন।

গ্রামবাসীরা সবই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, পন্ধারপুরের কাছে এসে উগ্রমূর্তি বন্যা হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল, রক্ষা পেল সেই গ্রাম ও গ্রামবাসীরা। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের এক সন্ধ্যায় ৮০ বছর বয়সে এই সাধক তাঁর ইহলৌকিক লীলা সমাপ্ত করেন, কিন্তু তার জীবনী সকলের মনে এক অনুপ্রেরণার সৃষ্টি করে মানুষ চাইলে দস্যু থেকেও সাধক হতে পারেন যদি তার মন পরিবর্তিত হয়, অর্থাৎ বাহ্যিক আচার বা লোকাচার নয় মনেতেই ভগবান রয়েছেন,মনই সব।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...