জ্ঞানদেবের সংস্পর্শে কুখ্যাত দস্যু হয়ে ওঠেন নামদেব

সুন্দর স্বাস্থ্যবান মারাঠি যুবক বিঠ্ঠলপন্থ বিয়ে করার কিছু সময় পরেই সংসারের মায়া ত্যাগ করে কাশী ধামে চলে যান। সেখানে তিনি রামানন্দ স্বামীর কাছে দীক্ষা নেন। একদিন রামানন্দ স্বামী তীর্থ করতে গিয়ে দৈব যোগে বিঠ্ঠলের জন্মস্থান আনান্দি গ্রামে আসেন। সেখানকার গ্রামবাসীরা যখন জানতে পারেন যে রামানন্দ স্বামী গ্রামে এসেছে তখন তারা তাঁকে দর্শন করতে আসেন। বিঠ্ঠলপন্থের স্ত্রী রখুমাবাঈও আসেন সেখানে। রখুমা বাঈ রামানন্দ স্বামীকে প্রণাম করলেন। স্বামীজি তাকে আশীর্বাদ করে তখন বললেন যে,“ তুমি সু সন্তানের জননী হও।” এই কথা শুনে রমণী অসম্ভব দুঃখের মধ্যেও হেসে উঠলেন। রামানন্দ স্বামী তখন জানলেন যে, এই নারীর কোন সন্তান নেই আর তার সন্তান হওয়ার কোন সম্ভাবনাও নেই কারণ তার স্বামী সন্তান হওয়ার আগেই সংসার ত্যাগ করেছেন।

রামানন্দ স্বামী আরও জানতে পারলেন যে, তার শিষ্য বিঠ্ঠলপন্থ ই এই নারীর স্বামী। সাধু বাক্য যাতে লঙ্ঘন না হয়, সেই কারণে তৎক্ষণাৎ রামানন্দ স্বামী আদেশ দিলেন যে, বিঠঠল পন্থ সন্তান জন্মাবার আগে স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে সংসার ত্যাগ করা উচিত নয়, যাও আবার সংসারে ফিরে গিয়ে তুমি সাংসারিক ধর্ম পালন করো। গুরুর আদেশ পেয়ে শিষ্য পুনরায় সংসারে ফিরে এলেন ক্রমে বিঠ্ঠল পন্থের তিনটি পুত্র সন্তান ও একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করলো। তিন পুত্রের নাম তিনি যথাক্রমে রাখলেন, নিবৃত্তিনাথ, জ্ঞানদেব, সোপানদেব ও কন্যার নাম রাখলেন মুক্তাবাঈ। বিঠ্ঠলের দ্বিতীয় পুত্র হলেন জ্ঞানদেব বা জ্ঞানেশ্বর, ১২৭১ খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানেশ্বরের জন্ম। জ্ঞান দেব সহ ভাই-বোন সকলেই ছোটো থেকে জ্ঞান উপাসনা ও যোগ বিদ্যায় পারদর্শী।

নিবৃত্তি নাথ ছোটোবেলায় গৈবিনাথ নাম নিয়ে এক সাধুর সঙ্গে পর্বত গুহায় যান ও ব্রহ্মবিদ্যা শিক্ষা করে। নিবৃত্তিনাথ এই ব্রহ্মবিদ্যা তার দুই ভাই ও বোন মুক্তাবাঈকে শেখান। বিঠ্ঠলপন্থ সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করেন,এরপর আবার সংসারে ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে , কারণ এটি ছিল সম্পূর্ণ শাস্ত্র বিরুদ্ধ। যে কারণে তাঁর ছেলেদের যখন পৈতের সময় হয় তখন খুব অসুবিধা সৃষ্টি হয়, বিঠ্ঠলপন্থ স্থানীয় পন্ডিতদের সঙ্গে এই পাপের প্রায়শ্চিত্তের উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। পন্ডিতেরা বলেন,“ এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হল স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করা।” এই কথা মেনে নিয়ে বিঠ্ঠল প্রয়াগে গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমে নিজের নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন।

জ্ঞানদেব যখন জানতে পারেন যে, যদি কোন সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী পুনরায় সংসারে ফিরে আসেন, তাহলে তার পুত্রেরা শাস্ত্রীয় বিধান মত পৈতে ধারণ করতে পারবে না,তখন জ্ঞান দেব নিজের অলৌকিক ক্ষমতা দেখান যা দেখে পন্ডিতরা ভাবতে শুরু করেন, ইনি কোন সাধারণ মানুষ নয়,নির্ঘাত ভগবানের অবতার।
তখন তার পৈতে ধারণের সময় জ্ঞান দেব পূর্বপুরুষদের আহ্বান করেন আর তারা সশরীরে সেখানে উপস্থিত হন। তারপর জ্ঞানদেব আনান্দি গ্রামে ফিরে আসেন ও পুরাণ, বেদান্ত প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ পাঠ ও ধর্মানুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে তার সময় কাটাতে থাকে।

রামায়ণ, ভগবদগীতা, যোগবাশিষ্ট ও শ্রীমদ্ভাগবত জ্ঞানদেবের প্রিয় বন্ধু ছিল,ক্রমে তাদের অনেক শিষ্য জুটল।

মাত্র ১৯ বছর বয়সে জ্ঞানেশ্বর গীতার টীকা লিখেছিলেন। জ্ঞান দেব রচিত এই গ্রন্থ জ্ঞানেশ্বরী নামে প্রসিদ্ধ। ৯০০০ শ্লোক নিয়ে এই বিরাট গ্রন্থখানি রচিত।

বাংলা ভাষাতেও জ্ঞানেশ্বরী গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশ হয়েছে। এই জ্ঞান দেবকে নিয়ে প্রচুর অলৌকিক কথা আছে। একবার এক মূমূর্ষু বৃদ্ধের মাথায় হাত দিতেই তার দেহে নতুন করে প্রাণশক্তি সঞ্চারিত হয় আর একবার একজন কুখ্যাত দস্যু জ্ঞান দেবের সংস্পর্শে এসে পরম ভক্ত সাধকে রূপান্তরিত হন, নতুন নাম হয় নামদেব। ২৫ বছর বয়সে তিনি চির সমাধি লাভ করেন। কথিত আছে যে, জ্ঞান দেবের চির সমাধি লাভ করার পর তিনি মাঝেমধ্যেই তার প্রিয়তম ভক্তদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে তাদের কথা বলেন তার অতি প্রিয় এক শিষ্য গোলাবরাকে তিনি শুধু দেখাই দেননি, একজোড়া পাদুকাও দিয়ে ছিলেন। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত এই ভক্ত পরম শ্রদ্ধাভরে সেই পাদুকা পুজো করে ছিলেন,এখনও নাগপুরে এই পাদুকা পুজো করা হয়ে থাকে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...