শিবের অবতার গোরখনাথের জীবন!

ঘরে চূড়ান্ত অভাব উপস্থিত! ভাঁড়ারে  চাল বাড়ন্ত,ঘরে পয়সা এতটুকুও নেই! কী উপায়ে হবে অন্নসংস্থান? বাড়ির গৃহিণী উঠানে একরাশ গোবর নিয়ে ঘুঁটে তৈরি করতে বসলেন, বাজারে বেঁচে যদি কিছু পয়সা পাওয়া যায়! তাহলে দিন গুজরান করা সম্ভব। তার ১২ বছর বয়সী ছেলে মায়ের পাশে বসে ঘুঁটে তৈরিতে মাকে সাহায্য করছে। এমন সময় সেখানে এসে হাজির হলেন এক সন্ন্যাসী! মায়ের পাশে বসে থাকা ১২ বছর বয়সী ছেলেকে দেখে সন্ন্যাসীর মনে ভাবান্তর হলো, সন্ন্যাসী সেই মাকে বললেন, "মাগো তোমার এই গোবরের স্তূপের মধ্যে থেকে আজ আমি আবিষ্কার করে গেলাম এক পদ্মফুলকে। তোমার কুল পবিত্র।‌ সারা দেশ ধন্য কিন্তু মাগো এই ছেলে ঘরে থাকবে না।" সন্ন্যাসীর কথা যে চরম সত্য তা যে বিফলে যাবার নয় তা প্রমাণিত হল পরদিন সকালেই।

হ্যাঁ, এই ঘটনার পরের দিন ঘুম থেকে উঠে মা আর ছেলেকে দেখতে পেলেন না! কোথায় গেল সেই ছোট্ট কিশোর? চিরতরে সংসার ত্যাগ করে সেই ছেলে চলে গেল! কোথায় চলে গেল? ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ছেলেটি সাধু সন্ন্যাসীর দলে চলে গেল। উত্তর ভারতে তখন যোগিনী কৌলসিদ্ধ মৎস্যেন্দ্রনাথের ভীষণ নাম ডাক, নবীন এই যুবক সংকল্প করলেন,তিনি সেই মহাসাধকের আশ্রয় গ্রহণ করবেন। এরপর শিব চতুর্দশীর পবিত্র দিনে পশুপতিনাথ দর্শন করার পরেই মৎস্যেন্দ্রনাথের দর্শন পাওয়া গেল, সিদ্ধ হল তার মনস্কামনা। দীক্ষার পর গুরু নতুন শিষ্যের নামকরণ করলেন গোরক্ষনাথ। এই নামই পরে গোরখনাথ বলে পরিচিত হয়।

মৎসেন্দ্রনাথ শিষ্যকে ধৌতি,বস্তি,নেতি,ত্রাটক,নৌলিক ও কপালভাতি এই ষট কর্ম সাধন শিক্ষা দিলেন, এতে সাধকের দেহে নানান রকমের শক্তি প্রকাশিত হয় এবং জরা মরণ তার আয়ত্ত হয়, এরপর আর‌ও দশটি মুদ্রা গুরু তাকে যত্ন সহকারে শেখালেন। গোরখনাথ গুরুর সাথে পর্যটনে বেরোলেন, কাশী,বৃন্দাবন, কেদার-বদরী প্রভৃতি দেখার পর রামেশ্বর,ত্র্যম্বক, পুষ্কর, দ্বারকা প্রভৃতি তীর্থ দর্শনও শেষ হলো, এবার বাকি থাকল হিংলাজ। নাথ যোগীদের কাছে হিংলাজ তীর্থের গুরুত্ব অনেক বেশি কিন্তু যেমন দুর্গম সেই তীর্থের পথ তেমনি বিপদ সংকুল! বহু কষ্ট সহ্য করে গোরখনাথ সেখানে পৌঁছালেন ও দেবীর দর্শন ও পুজো হোম করে তার মন আনন্দে ভরে উঠল। 

গুরুদেবের নির্দেশ অনুযায়ী গোরখনাথ মন্দিরে ঢুকে ধ্যানস্থ হলেন , শেষ রাত্রে চিন্ময়ী মূর্তিতে দর্শন দিলেন দেবী হিংলাজ। বর দিলেন- "বৎস তোমার ত্যাগ বৈরাগ্য ও সাধন নিষ্ঠায় আমি প্রীত হয়েছি, আশীর্বাদ করি তুমি আজ থেকে অষ্টসিদ্ধির অধিকারী হবে। তুমি মহাতীর্থ অমরনাথ এ গিয়ে বিগ্রহীভূত পরম শিবকে স্পর্শ করে ধন্য হও।" পদব্রজে পথ চলতে চলতে গুরু ও শিষ্য এরপর উভয়ে এসে উপস্থিত হলেন কাশ্মীরের অমরনাথে। দেবাদিদেবের অত্যাশ্চর্য প্রতীক তুষার লিঙ্গ দর্শন ও স্পর্শ করে ধন্য হলেন গোরখনাথ। এরপর বিচ্ছেদের পালা। গুরুদেব বললেন," তুমি নিজের পথে অগ্রসর হও। অশ্রু ভারাক্রান্ত নয়নে গোরখনাথ একা পথ চলতে লাগলেন খ্যাত অখ্যাত বহু তীর্থ ও সিদ্ধ পীঠ দর্শন করবার পর হিমালয়ের তরাই অঞ্চলে এক নিবিড় বনে মানস সরোবরের তীরে এসে উপস্থিত হলেন তিনি। হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন অলক্ষে গুরুর কন্ঠস্বর- "বৎস এইটি তোমার নির্দিষ্ট সাধনা স্থল। এখানেই সাধন ভজন করো।"। এই সরোবরের তীরে ১২ বছর কঠোর সাধনার পর গোরক্ষনাথ দেবাদিদেব মহাদেবের সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন।

মহাদেব বললেন-"বৎস গোরখনাথ আমি বর দিলুম কায়াসিদ্ধি ও নাথত্ব তুমি অর্জন করো।" যোগী বর গোরখনাথের একাগ্র সাধনার খ্যাতি অল্পকালের মধ্যে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তার সাধন পীঠে ধীরে ধীরে জড়ো হতে থাকে মুক্তি কামী নরনারী ও যোগী সন্ন্যাসীর দল। ক্রমে ক্রমে এই অঞ্চলটি সিদ্ধ সাধক গোরখনাথের নাম অনুসারে গোরখপুর নামে পরিচিত হয়।  পূর্ব ভারত পর্যটন করার সময় গোরখনাথ এলেন ত্রিপুরা রাজ্যে। ত্রিপুরা রাজ তিলকচন্দ্র তাকে অত্যন্ত সমাদর করে প্রাসাদে নিয়ে এলেন। কিশোরী রাজকন্যা শিশুমতিকে দেখে গোরক্ষনাথ চমকে গেলেন,কারণ এ তো সামান্য মেয়ে নয়! সিদ্ধা যোগিনীর সব লক্ষণ রয়েছে এর দেহে। মহাযোগীর প্রবল ইচ্ছায় শিশুমতির দীক্ষা সম্পন্ন হল। তার নতুন নামকরণ হল ময়নামতি। অল্পকালের মধ্যেই কিশোরী ময়নামতি যোগ সাধনায় পারদর্শিনী হয়ে উঠলেন, তার বিবাহ হয় বঙ্গালরাজ মানিক চন্দ্রের সাথে। এদেরই পুত্র গোপীচাঁদ যিনি রাজপুত্র হয়েও মাত্র আঠারো বছর বয়সে রাজ্য সুখ সম্পদ ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিলেন। 

গোরখনাথ শুধু ভারতের অন্যতম সিদ্ধাচার্য ও শৈবযোগী বলেই পরিচিত নন, এদেশের সাধক ও সাধারণ ভক্ত নরনারীর দৃষ্টিতে তিনি এক আরাধ্য দেবতা রূপে অধিষ্ঠিত। শিবের অবতার রূপে তিনি বহু স্থানে পূজিত হয়ে থাকেন। তবে কানফাটা নাথ যোগীদের মঠ মন্দিরেই তার বিগ্রহ বিশেষ ভক্তি সহকারে অর্জিত হয়।

গোরক্ষনাথ যে ধর্ম সংস্কার করেন তার বৈশিষ্ট্য হল, এতে জাতি বা বর্ণের কোনো বিচার নেই। ইষ্টদেব শিবের উপাসনা সবাই অবাধে করতে পারে। অবধূত ও নাথ হওয়ার যোগ্যতা এবং জীবনমুক্ত হওয়ার অধিকার যে কোন সাধকেরই আছে। মহাযোগী গোরখনাথের মূল্যবান উপদেশ ছিলো- শুধু অর্ধনগ্ন হয়ে জটা ভার মাথায় নিয়ে ভিক্ষা করে বেড়ালেই কি যোগ হয়? বুকের মাঝে জ্বালিয়ে নাও বিশ্বাসের জ্বলন্ত আগুন আর এই আগুনই তোমাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে কৃচ্ছ সাধনের পথে ঈশ্বরপ্রাপ্তির পথে! দেহ মনের চরম নির্যাতন ও লাঞ্ছনা হাসিমুখে সইতে হবে, মরনকে শিবসমান মনে করতে হবে তবেই ঘটবে প্রকৃত যোগ প্রাপ্তি! সাধকের মনের সূক্ষ্মতম ইচ্ছার বিলয় আর মনের বিয়োগ হলেই  পরম শিবের সঙ্গে যোগস্থাপন ঘটবে।" পাঞ্জাবের এক অখ্যাত গ্রামে গোরক্ষনাথ আবির্ভূত হয়েছিল, পাঞ্জাবের জনশ্রুতি ও গল্পকথায় তার শিষ্য গূগা, পূরন ভগৎ,রনঝার নানা কাহিনী শোনা যায়। সেই সব শিষ্যদের অধিষ্ঠান কাল অষ্টম থেকে একাদশ শতক। তাই গোরখনাথকেও সেই কালের লোক বলে অনায়াসে গণ্য করা যায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...