মৃত মানুষকেও দীক্ষা দিয়েছিলেন ভোলানন্দ গিরি

জয় শঙ্কর বলতে বলতে দরজায় এসে দাঁড়ালো দণ্ড কুমুন্ডলধারী এক সন্ন্যাসী। ঘরের গৃহকর্ত্রী তার ডাক শুনেই বুঝলেন,ভিক্ষার জন্য কেউ এসেছেন! নন্দা দেবী তখন ভিক্ষার চাল হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে এলেন!কিন্তু কি আশ্চর্য!‌ সন্ন্যাসী নন্দা দেবীর চরণে প্রণাম করে বসলেন!নন্দা দেবী লজ্জিত হয়ে বললেন,“ এ কী করলেন বাবা!সন্ন্যাসী সকলের প্রণম্য!আপনি আমাকে প্রণাম করলেন?”সন্ন্যাসী বললেন,“ তাতে কোন দোষ নেই মা। মাতৃরূপে আপনাকে প্রণাম করেছি” বলেই সন্ন্যাসী দ্রুত পদে সেখান থেকে চলে গেলেন। এই সন্ন্যাসীকে দেখে চমকে উঠলেন নন্দা দেবী। চেহারাটা অনেক পরিচিত। তবে কি এই সন্ন্যাসী তার হারানো ছেলে ভোলা দাস? সত্যিই ভোলা দাস‌ই সেদিন এসেছিলেন।

দীক্ষা নেওয়ার পরে গুরুদেব তাকে বলেছিলেন গর্ভধারী জননীর চরণ বন্দনা ও মাতৃভূমি দর্শন করে আসতে হবে তাকে, ভোলানাথ তাই করে গেলেন। পাঞ্জাবের  খুরদা গ্রামে জন্মগ্রহণ হয়েছিল ভোলানাথের। তারা ছিলেন সারস্বত শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। ভোলানাথের মায়ের নাম ছিল নন্দা দেবী আর ভোলানাথের পিতার নাম ছিলো,ব্রহ্মদাস। তাদের দ্বিতীয় সন্তান এই ভোলা দাস,তাঁর জন্ম হয় ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে। তাদের প্রথম সন্তান রতন দাস একদিন রাত্রে ঘর ছেড়ে কোথায় চলে যায়, তারপর দ্বিতীয় ছেলের জন্ম হয় কিন্তু এই ছেলেও ঘরে থাকে না। সেও চলে যায় সন্ন্যাসের পথে। ভোলা দাসের নাম এখন ভোলানন্দ গিরি।

bholananda giri

পস্তানার বিখ্যাত আশ্রম গুরু গোপালগিরির আশ্রয়ে তাকে ১২ বছর কৃচ্ছ সাধনাতে  নিযুক্ত থাকতে হলো।  তারপর তার গুরু একদিন তাকে  বললেন,“ ভোলা তুই অন্য কোথাও গিয়ে নিজের আশ্রম কর,তোর সাধনা পূর্ণ হবে। ” গুরুর থেকে কৃপা বাক্য লাভ করার পর কয়েকজনকে সাথে নিয়ে ভোলানন্দ তপস্যার পথে যাত্রা শুরু করলেন। এরপর তারা গিয়ে পৌছলেন হিমালয়ে। কখনো হিমালয়ের পর্বত গহ্বরে,কখনো হরিদ্বারের কাছে, কখনো বিল্বকেশ্বর পর্বতে, তিনি যোগ সাধনা শুরু করলেন। বহু বাধা বিঘ্নকে অতিক্রম করে তার সাধনা শুরু হলো।

এই সাধনার সময় একটি ঘটনার কথা বলি, একবার ভোলানন্দ তার কয়েকজন গুরু ভাইয়ের সঙ্গে হিমালয়ে যোগ সাধনায় নিমগ্ন রয়েছেন, হঠাৎ একটা বিরাট বাঘ সেখানে এসে উপস্থিত হলো। ভোলানন্দ তার সঙ্গীতের সাহস দিয়ে বললেন,“ ভয় কী! এসো প্রত্যেকেই নিজের বীজ মন্ত্র জপ করি। জপের অসীম শক্তি,হিংস্র জন্তু আমাদের কিছুই করতে পারবে না।”

 একজন সাধু কিন্তু বড় ভয় পেলেন নিজের আসন ছেড়ে যেই তিনি পালাতে যাবেন অমনি বাঘটা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ও সাধুটার দেহ টেনে নিয়ে  জঙ্গলের দিকে চলে গেলো। এরপর হিমালয়ের অরণ্যে ভোলানন্দ ধ্যান করতে বসলেন, একদিন পর্বত গুহা আলো করে দেবাদিদেব শঙ্কর দেখা দিলেন। ভোলানন্দের সাধনা সেই দিন সফল হলো।

এরপর আরম্ভ হল ভোলানন্দের তীর্থ পরিক্রমা ও দেশ পর্যটন। শুধু ভারতবর্ষের দূরদূরান্তে তীর্থস্থান গুলি নয়, বহির্ভারতের দুর্গম তীর্থ গুলিও তিনি পরিভ্রমণ করলেন। বোম্বাই শহরে প্রত্যহ মাধুকরী করে তিনি রোজকার খাবার সংগ্রহ করেন। একদিন এক ধনীর প্রাসাদে গিয়ে তিনি ভিক্ষা চাইলেন ধনী সেই ব্যক্তিটি ও তার স্ত্রীর নবীন সন্ন্যাসীর দিব্য কান্তি দেখে নিজেদের সুন্দরী কন্যার সঙ্গে সন্ন্যাসীর বিবাহ দেওয়ার জন্য অভিলাষ জ্ঞাপন করে জানালেন যে, বিবাহ অনুষ্ঠানের পরেই তারা দুজন সংসার ত্যাগ কর তীর্থাবাস করবেন এবং সন্ন্যাসী জামাতা ও কন্যা তাদের বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হবেন। ভোলানন্দ প্রস্তাব শুনে হেসে বললেন আপনারাই যখন ধন-সম্পদে  বীতস্পৃহ হয়ে তীর্থ বাসের ইচ্ছা পোষণ করছেন, তখন আমার মতো সন্ন্যাসীকে কেন পার্থিব ভোগ সুখের প্রলোভন দেখাচ্ছেন? আমাকে ক্ষমা করুন। আমার জীবনের পথ চিরতরে চিহ্নিত হয়ে গেছে। ফেরার পথ নেই।”

১৮৯৩ সালে প্রয়াগে কুম্ভ মেলায় ভোলাগিরি মহারাজ জনমন্ডলীর সামনে আত্মপ্রকাশ করেন এই কুম্ভ মেলায় সাধক বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামীকে নিয়ে সন্ন্যাসীদের মধ্যে মতবিরোধের সৃষ্টি হয়। বিজয়কৃষ্ণ সন্ন্যাসীদের নির্দিষ্ট স্থানে তাবু ফেলতে গেলে আপত্তি ওঠে , সামাজিক দিক দিয়ে বিচার করলে তিনি গৃহী, তাই একদল সন্ন্যাসী তাদের মধ্যে বিজয়কৃষ্ণ কে স্থান দিতে অসম্মত হন কিন্তু ভোলানন্দ গিরি আনন্দে তাকে অভ্যর্থনা করেন,বিজয় কৃষ্ণকে তিনি সম্বোধন করেন ‘মেরে আশুতোষ’।

হরিদ্বারের লালতারাবাগ আশ্রমের শান্তশিষ্ট পরিবেশে বসবাস করতেন ভোলানন্দ গিরি মহারাজ, সন্ন্যাসী শিষ্যদের চরিত্র গঠনের দিকে তিনি কড়া নজর রাখতেন এবং সেদিক থেকে দেখতে গেলে তার অবদান কিছু কম নয়। লোক দেখানো বৈরাগ্য থেকে শিষ্যদের শত হস্ত দূরে থাকার উপদেশ দিতেন। প্রাত্যহিক কর্তব্য পালনের মাধ্যমে সাধন ভজন কর- এই ছিল তার সরল নির্দেশ। তিনি আরো বলতেন যে, “কর্মে আলস্য করতে নেই, কাজ না করে বসে অন্ন খেলে পাপ হয়। গৃহস্থেরা কষ্ট করে নিজেরা না খেয়ে সাধুকে দান করেন। তোরাও কর্মকে তপস্যা জ্ঞান

করবি। নিষ্ঠাভরে খুব পরিশ্রম করবি আর তপস্যা করবি। মাটি কাটা, ঘাসকাটা, কুয়া থেকে জল তোলা গাভীর পরিচর্যা করা, গোয়াল পরিষ্কার রাখা এসব কাজে লজ্জা কিসের? সংকোচ কীসের? আমার মতো চাষী গুরুর কাছে থাকলে তোদের ও চাষী গিরি করতে হবে রে।”

১৯০২ সালে ভোলানন্দ মহারাজের দুটি চক্ষু ব্যাধিতে আক্রান্ত হলো। তাকে তখন কলকাতাতে এনে অনেক চিকিৎসা করানো হলো কিন্তু কোনো ফল হলো না। সত্যি তিনি তাঁর দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেললেন আবার ফিরে গেলেন হরিদ্বারের আশ্রমে। সেখানে এক তরুণ মাড়োয়ারী সন্ন্যাসী মন প্রাণ ঢেলে ভোলানন্দ গিরির সেবা করে। গিরিজির দৃষ্টিশক্তি হারানোর জন্য কোন খেদ নেই মনে, সারাদিন ব্রহ্মানন্দে নিমজ্জিত হয়ে থাকেন গুরুজি। শিষ্যটির কিন্তু মনে বড় দুঃখ। গুরুজির অন্ধত্ব কেন ঘোচে না? কিছুদিন পর শিষ্যটি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলো,মৃত্যু আসন্ন, তবু সজল নয়নে ঈশ্বরের নিকট তার একমাত্র প্রার্থনা, গুরুজীর চোখ ভালো করে দাও প্রভু। তরুণ সন্ন্যাসীর মৃত্যু হলো। কয়েকদিন পর ভোলানন্দ গিরির ধ্যানমগ্ন অবস্থায় শুনতে পেলেন দিব্য কণ্ঠ তাকে বলছেন,“ ভোলা চেয়ে দেখ, আমরা কে? গিরিজি সেদিন হর পার্বতীর যুগল মূর্তি দর্শন করেন ও একটি চোখের দৃষ্টি শক্তি তিনি ফিরে পান।

সুপ্রসিদ্ধ গণিতবিদ সোমেশ চন্দ্র বসুর স্ত্রী অকালে মারা যান স্ত্রীর মৃত্যুর পর তার মধ্যে তীব্র বৈরাগ্যের সঞ্চয় হয়। তিনি মনে মনে স্থির করেন যে শক্তিধর যোগী তার মৃতা সহধর্মিনীর সঙ্গে একত্রে তাকে দীক্ষা দিতে পারবেন শুধু তার শিষ্যত্বই গ্রহণ করবেন তিনি। এই ইচ্ছা মনের মধ্যে পুষে রেখে বহু সাধু সন্ন্যাসীর কাছে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে সোমেশ চন্দ্র এলেন ভোলানন্দ গিরির কাছে। সবকিছু শুনেও ভোলানন্দ তাকে দীক্ষা দিতে রাজি হলেন।  নিভৃত স্থানে তাদের দীক্ষা দেওয়ার জন্য তিনটি আসন পাতা হলো। ভোলানন্দ ও সোমেশ চন্দ্র দুটিতে বসলেন অনুষ্ঠান শুরু হলে সোমেশচন্দ্র দেখলেন অপর আসনটিতে তার মৃতা স্ত্রী এসে বসেছেন। দীক্ষা অনুষ্ঠান শেষ হবার সাথে সাথে তার স্ত্রী অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এই রকম বহু অলৌকিক কার্যকলাপ করেছিলেন এই ভোলানন্দ গিরি। বহু মানুষ তার উপকার পেয়ে উপকৃত হয়েছিলেন। বহু মানুষ হয়েছিলেন মুগ্ধ।‌ এইভাবেই প্রচুর মানুষের হিত সাধন করে ১৯২৮ সালের ৮ মে শরীর ত্যাগ করে চলে যান ভোলানন্দ গিরি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...