ইংরেজদের হাতে ধরা দেবেন না বলে ডাক্তারির ছাত্র নিজেই ক্ষতস্থানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বেছে নিয়েছিলেন মৃত্যুর পথ

বিনয় বসু ছিলেন বাংলার অলিন্দ যুদ্ধের বীরত্রৈয়ীর সেনানায়ক। বাংলার অলিন্দ যুদ্ধের বীরত্রৈয়ীর অন্যতম সেনাপতি তিনি। পুরো নাম বিনয় কৃষ্ণ বসু। পরিচিত ছিলেন অবশ্য  ‘বিনয় বসু’ নামেই।  বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স এর ঢাকা শাখার সদস্য ছিলেন।

ভালবাসতেন সাইমন বলিভারের স্লোগান। মনে প্রাণে ‘স্বাধীনতা ছাড়া কারো পিতৃভূমি থাকতে পারে না’। ছোটবেলা থেকে সাহসী আর ডাকাবুকো। কিন্তু পড়াশোনা তুখোড়। মুন্সীগঞ্জের রোহিতভোগ গ্রামের ছেলেকে একডাকে চিনত মানুষ। ম্যাট্রিক পাশ করে ডাক্তারি পড়তে ঢাকার মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। বাবা রেবতীমোন বসু ছিলেন পেশায় ইঞ্জিনিয়র। পুত্র বিনয় জীবনের শুরু থেকেই চেয়েছিলেন ডাক্তার হব্যাং। কিন্তু জীবন বদলে দিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। স্বাধীন দেশে অন্য ভোর আনতে জড়িয়ে পড়লেন মুক্তি সংগ্রামে। 

সময়টা ১৯২৮-১৯২৯। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে রাজবন্দী অনেক বিপ্লবী। জেলের পুলিশ সুপারদের উদ্দেশ্যই ছিল বন্দিদের থেকে স্বীকারোক্তি আদায়। সে জন্যেই বন্দীদের উপর চলছিল অকথ্য অত্যাচার। কিন্তু উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়া অত্যাচারেও মুখ খোলেনি কোন রাজবন্দী। দেশের স্বাধীনতার কাছে তাঁরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। সেই সময় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের কমিশনার ছিলেন কর্নেল সিম্পসন। রাজবন্দিরা কোনভাবেই সিম্পসনের অত্যাচারের কাছে মাথা নোয়ায় নি। ওই সময় জেলে বন্দী ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, সত্যেন্দ্রনাথ বক্সীর মতো নেতৃত্বও। রাজবন্দীদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদ-স্বরূপ তাঁরা কর্নেল সিম্পসনের সঙ্গে অসহযোগিতা শুরু করলেন। ক্রুদ্ধ সিম্পসন লাঠিপেটা করেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে। এই অত্যাচারের খবর খুব সহজেই জেলের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। ইংরেজরা ভেবেছিল বিপ্লবীরা হয়তো ভয় পেয়ে স্বীকারোক্তি দেবে। কিন্তু তাঁরা যে 'মাভৈ' মন্ত্রে দীক্ষিত। ভয় পাওয়া তো দূর অস্ত, এই অত্যাচারের কথা জানতে পেরে বিভিন্ন স্বদেশী দলগুলো ইংরেজকে শায়েস্তা করার জন্য ফুঁসতে লাগল।

বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। সুভাষচন্দ্র বসু এই দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই সময় এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন হেমচন্দ্র ঘোষ। দলের বাকি সদস্যরা নেতাজির উপর হওয়া অন্যায়ের বিচার করার সিদ্ধান্ত নিল। সদস্যদের সঙ্গে সহমত হলেন স্বয়ং দলের নেতা হেমচন্দ্র ঘোষ।

অত্যাচারী কর্নেল সিম্পসন বসতেন মহাকরণে। ঠিক হল, গুহায় ঢুকে সিংহকে হত্যা করা হবে। মহাকরণের অলিন্দে আরো অনেক পুলিশ কমিশনারের কর্মস্থল ছিল। বিপ্লবীদের কাছে এ ছিল সুবর্ণ সুযোগ। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের বিপ্লবী সদস্যরা। হেমচন্দ্র ঘোষ এই কাজের দায়িত্ব দিলেন তিন সাহসী, দেশপ্রেমিক যুবককে। বিনয় কৃষ্ণ বসু, বাদল গুপ্ত এবং দীনেশ চন্দ্র গুপ্ত। বিনয় বসু এই দুঃসাহসিক মহাকরণ অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন।

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স-এর অ্যাকশন স্কোয়াডের সদস্য রসময় সুর এবং নিকুঞ্জ সেনের তৎপরতায় বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত এবং দীনেশ চন্দ্র গুপ্ত পৌঁছলেন রাইটার্স বিল্ডিং-এ।

দিনটা ছিল ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর। রাইটার্স বিল্ডিং-এর সামনে ট্যাক্সিটা এসে দাঁড়িয়েছিল আনুমানিক বেলা বারোটা নাগাদ। ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়লেন ইউরোপীয় সাজে সজ্জিত দেশমাতার তিন বীর সন্তান। পরনের পোশাক একেবারে সাহেবী। দেখে বোঝার উপায় নেই এই তিন বিপ্লবী দেশের উদ্দেশে প্রাণ নিবেদন করতে এসেছেন। তাই একেবারে নিশ্চিন্ত হয়েই মহাকরণের পাহারাদাররা তিন বিপ্লবীকে সেদিন রাইটার্সে ঢোকা থেকে বাধা দেননি। বরং এই তিন আগন্তুককে বিশিষ্ট ব্যক্তি মনে করে সেলাম ঠুকেছিল।

বিনয়, বাদল, দীনেশ কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই সোজা সিঁড়ি ধরে মহাকরণের দোতলায় উঠে গেলেন। সেখানে একটা সুরক্ষিত কক্ষে বসতেন উর্দ্ধতন প্রশাসনিক কর্তারা। তাঁরা তিনজনে এসে দাড়ালেন কর্নেল সিম্পসনের ঘরের সামনে। সিম্পসন তখন তাঁর চেয়ারে বসে সচিব জ্ঞান গুহর সঙ্গে কথা বলছিলেন। তাঁরা কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই গর্জে উঠলো তিন নির্ভীক বিপ্লবীর হাতের আগ্নেয়াস্ত্র। কেঁপে উঠেছিল রাইটার্সের দেওয়াল। এক অত্যাচারীকে শাস্তি দিতে পেরে সেদিন বিপ্লবীরা দেশের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছিল।

সেদিন মহাকরণের অলিন্দ সাক্ষী হয়েছিল আরো মৃত্যুর। অন্যায়কারী, অত্যাচারী ব্রিটিশ-প্রভুরা যথাযোগ্য শাস্তি পেয়েছিল এই তিন বিপ্লবীদের হাতে। এদিকে বিনয়, বাদল, দীনেশকে লক্ষ্য করে পিস্তল থেকে গুলি ছুড়লেন ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ ইন্সপেক্টর-জেনারেল মিস্টার ক্রেগ। বিপ্লবীরা এত সহজে হার মেনে নেওয়ার লোক নন। রক্তের স্রোত বয়ে গিয়েছিল সেদিন। অনেক পুলিশ ইন্সপেক্টররা পালিয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। এদিকে পুলিশ কমিশনার মিস্টার টেগার্ট তাঁর পুলিশ বাহিনী নিয়ে লালবাজার থেকে রাইটার্সে পৌঁছে যান। রাইটার্সকে ঘিরে তখন রণক্ষেত্র সজ্জিত হয়েছে। ভেসে আসছে বন্দেমাতরম ধ্বনি।

এক সময় শেষ হয়ে গেল এই তিন বিপ্লবীর পিস্তলের গুলি। কিন্তু তাঁরা নিজেদের জন্য মারণাস্ত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। পটাশিয়াম সায়ানাইডের পুরিয়া। অত্যাচারী ইংরেজদের হাতে বন্দী হবেন না এই পণ ছিল তাঁদের। বিপ্লবী বাদল গুপ্ত পটাশিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছিলেন মহাকরণের মেঝেতে। দীনেশ গুপ্তও সেই চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। বিনয় বসু গুরুতর আহত হয়েছিলেন দুঃসাহসিক অভিযানে।

হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। চিকিৎসায় সাড়া দিয়ে মাথার ক্ষত যখন সবে শুকাতে শুরু করেছে তখন ডাক্তারির ছাত্রটি ব্যান্ডেজ খুলে নিজেই ক্ষতস্থানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিলেন। জীবিত অবস্থায় কিছুতেই ধরা দেবেন না এই ছিল পণ। তাঁর মৃত্যুকৌশল কাজ করেছিল। ১৩ ডিসেম্বর এই বিপ্লবী পাড়ি দিলেন মহাপ্রস্থানের পথে।   

দীনেশ গুপ্তের ফাঁসি হয়েছিল। মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত এই তিন বিপ্লবীর দুঃসাহসিক মহাকরণ অভিযান ইতিহাসের পাতায় 'অলিন্দ যুদ্ধ' নামে পরিচিত।

বিপ্লবী বিনয় বসুকে উদ্দেশ্য করে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন,

“ধন্যি ছেলে, দেখিয়ে গেছে আমরাও জবাব দিতে জানি”।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...