সময়টা ১৯৩০ সালের ডিসেম্বর মাস। কলকাতা মেডিকেল কলেজ। আহত এক বিপ্লবী সেদিন খানিকটা সুস্থ বোধ করছিল। তবে মনে ছিল অস্বস্তি। সে জানতো তাঁর এই সুস্থতার খবর ব্রিটিশ প্রশাসনের ঘুম কেড়ে নেবে। গোপন তথ্য আদায়ের জন্য শুরু হবে অকথ্য অত্যাচার। কিছুদিন আগেও এই অত্যাচারের সীমা সহ্য করার সুযোগ হয়েছিল এই নির্ভীক মানুষটির। তাই আর একবার ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচারের কাছে নিজের দৃঢ় সংকল্পের সমর্পণের ইচ্ছা ছিল না তার। তিনি জানতেন তাঁর কাছ থেকে কোন স্বীকারোক্তি আদায় করা অসম্ভব। আর অত্যাচারের পরেও বিপ্লবীদের গোপন কার্যকলাপের সংবাদ না দিয়ে যদি বেঁচে থাকেন জুটবে ফাঁসির দড়ি। দেশমাতৃকার জন্য ফাঁসি বরণ করতে তাঁর আপত্তি নেই, কিন্তু এই ফাঁসির দড়িতে ব্রিটিশের হাতের ছোঁয়াকে তিনি ঘৃণা করেন। এমন পরিস্থিতিতে এই বীর মানুষটি নিজের কর্তব্য স্থির করে নিলেন। সেই সময় তাঁর বেডের কাছে ডাক্তার , নার্স কেউই ছিল না। ধীরে ধীরে খুলে ফেললেন মাথার ব্যান্ডেজ। তিনিও একসময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন। তাঁর জানা আছে মাথার ক্ষতের অবস্থা। মাথার শুকিয়ে আসা ক্ষতস্থানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়ে ক্ষতস্থানটি তছনছ করে ফেললেন। ক্ষতস্থান থেকে দরদর করে পড়তে লাগল রক্ত। রক্তে ভিজে গিয়েছিল তাঁর দেহ আর হাসপাতালের বিছানা। ব্যথায় লুটিয়ে পড়লো এক সাহসী , নির্ভীকচিত্তের দৃঢ় চেতনাময় পুরুষ। বিনয় বসু। দেশমাতার পদতলে যেন একগুচ্ছ লাল ফুলের অঞ্জলি। ব্যথায় শেষ মুহূর্তে চিৎকার করে উঠেছিলেন বিনয় বসু। শুনতে পেয়ে ছুটে আসেন হাসপাতালের নার্স। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বিছানা। ক'দিনের মধ্যেই বিনয়ের মাথার ঘা'য়ে সেপটিক হয়ে গেল। ১৩ ই ডিসেম্বর ডাক্তার-নার্সের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে তিনি চলে গেলেন।
ঢাকার রেবতীমোহন বসুর কনিষ্ঠপুত্র বিনয় বসু ১৯০৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলেন বিনয়। তাঁর বাবা ছিলেন ভালো শিকারি। প্রথম থেকেই বন্দুক ছিল বিনয়ের বাড়িতে। বিনয় বন্দুক চালাতে জানতেন। তবে দেশের প্রয়োজনে রাইফেল বা পিস্তল থেকে গুলি ছোড়ার শিক্ষা তিনি বাড়িতে পাননি। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সএর সদস্য বিনয় বসু তাঁর লক্ষ্যে অবিচল থাকতেন। অব্যর্থ ছিল তাঁর নিশানা। এই শিক্ষা তিনি পান বিপ্লবী দলে যোগদান করার পর। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন বিনয় বসু। ভালো টেনিস খেলতে পারতেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করার সময়ে দেশের স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যাগ্র ছিলেন। তখন বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দলে যোগদান করেন। সেই সময় ওই দলের কর্ণধার ছিলেন হেমচন্দ্র ঘোষ। ধীর, শান্ত মস্তিষ্কের হেমচন্দ্র ঘোষ সমস্ত পরিকল্পনা করতেন বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। তাঁর চিন্তাভাবনা ছিল স্বচ্ছ। বিনয় বসুর সর্বদা আত্মনিবেদনে উন্মুখ থাকা তাঁকে বিনয়কে ভরসা করতে শিখিয়েছিল। তাই ১৯৩০ সালে রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান যা ইতিহাসে 'অলিন্দ যুদ্ধ' নামে খ্যাত তাঁর পরিচালনার ভার দিয়েছিলেন বিনয় বসুকে। এই অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল কারা বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল সিম্পসন সাহেবকে বন্দী বিপ্লবীদের উপর করা অকথ্য অত্যাচারএর শাস্তি দেওয়া। এই অভিযানেই আহত হয়েছিলেন বিনয় বসু।
আন্দামানের সেলুলার জেলে বিপ্লবী দের সঙ্গে পশুর মতো ব্যবহার করা হতো। এই বর্বরতাকে নেতৃত্ব দিতেন কুখ্যাত চার্লস টেগার্ট। তাঁর সঙ্গে আরো কিছু পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলেন। সমস্ত বিপ্লবী দলই তাঁদের শাস্তি দিতে চাইতেন। টেগার্টকে হত্যা করার সকল চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল। বিনয় সেই দুঃখ মুছে দিয়েছিলেন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ লোম্যান এবং পুলিশ সুপার মিস্টার ই. হাডসনকে হত্যা করে। স্বাধীনতার মুক্তমঞ্চ গঠনে তাঁর অবদান বাঙালি হৃদয়ের পীঠস্থান আলো করে থাকবে।