‘Blindness is a new feeling, a new experience, a new state of being’.
“ ব্লাইন্ডনেস ইজ অ্যা নিউ ফিলিংস, অ্যা নিউ এক্সপেরিয়েন্স, অ্যা নিউ স্টেট অফ বিয়িং”
চোখের আলো হারিয়ে যাওয়ার পর অন্ধকারের মধ্যে নতুন দেখাকে খুঁজে নিয়েছিলেন তিনি। নিজের অন্ধত্ব সম্পর্কে বলেছিলেন, “ অন্ধত্ব এক নতুন অনুভূতি, এক নতুন অভিজ্ঞতা, এক নতুন ধরণের বেঁচে থাকা’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর আশ্রয়। কলাভবনের শুরুর সময় থেকে নন্দলালের ছাত্র। একটা চোখ প্রায় অন্ধ, অপরটি ক্ষীণ দৃষ্টি। দেখাই যে শিল্পের আসল কথা সেখানে ক্ষীণ দৃষ্টির এই ছাত্রকে শুরু থেকেই শিল্পগুরু খুব পছন্দ করেননি। চোখের আলোয় বিশ্বভুবন ধরা না দিলেও এই মানুষটি বিশ্বভুবনকে দেখে ছিলেন অন্তরের আলোয়। আর সেই আলোকেই আলোকিত হয়ে উঠেছিল ভারতের আধুনিক চিত্রকলা। জ্যোতির্ময় সেই শিল্পীর নাম বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। প্রমাণ করেছিলেন চোখের আলো ফুরিয়ে এলেও ফুরিয়ে যান না শিল্পী।
বিনোদবিহারীর জন্ম ১৯০৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। কলকাতার বেহালায়। বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতায়।
ছোটবেলা থেকেই স্বাস্থ্য ভুগিয়েছে। পরিবার উদ্বিগ্ন ছিল সে নিয়ে। দৃষ্টি শক্তির কারনেই স্কুলের গণ্ডির প্রথাগত পাঠ হয়নি। ক্ষীণ দৃষ্টিকে সম্বল করে চলে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন। কবিগুরুর সান্নিধ্যে। দাদা বনবিহারী তাঁকে নিয়ে এলেন। তার আগে অবশ্য নিজের আগ্রহে বাড়িতেই সাহিত্যের পাঠ নিয়েছিলেন।
ছোট থেকে আগ্রহ ছিল ছবি আঁকার দিকে। তাই গুরুদেব যখন কলাভবন শুরু করলেন তখন শিল্পাচার্য নন্দলালের ক্লাসে ভর্তি হলেন। কিন্তু নবাগত ছাত্রের চোখের অবস্থা দেখে তিনি খুব একটা আশাবাদী হলেন না তাঁকে নিয়ে। অন্য ছাত্রদের প্রতি যতটা নজর থাকত বিনোদবিহারীর প্রতি তা ছিল না।
একধারে চুপ করে বসে থাকতেন রঙ-তুলি নিয়ে। যা যেভাবে দেখতে পেতেন তাই আঁকতেন। রবীন্দ্রনাথ শিল্পাচার্যকে বললেন, আঁকতে চায় তো আঁকতে দাও। সেখানেই বন্ধু পেলেন রামকিঙ্কর বেইজকে। দুই ভিন্ন ব্যক্তিত্বের মানুষ, একজন ধীর, শান্ত আর অন্যজন দুর্দান্ত।
বিনোদবিহারীর নিজস্ব দেখা ক্রমশ ধরা দিল ছবিতে। শান্তিনিকেতনের রুক্ষ প্রান্তর, সাঁওতাল জীবন, একাকিত্ব সব মিলেমিশে যেতে লাগল।
কলাভবনের পাঠ শেষ হয়ে যেতে তিনি শান্তিনিকেতনের লাইব্রেরির কর্মী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
একটা সময় কলকাতায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে তাঁকে পাঠান মাস্টারমশাই নন্দলাল।
পরবর্তী সময়ে বিনোদবিহারী নেপাল আর্ট মিউজিয়াম কিউরেটর এবং শিক্ষা উপদেষ্টা হয়ে নেপাল চলে যান। পরবর্তী সময়ে রাজস্থান এবং মসৌরি। এক সময়ে শান্তিনিকেতনে কলাভবনের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
শান্তিনিকেতনে হিন্দি ভবনের দেওয়ালে তৈরি তাঁর মুর্যাল তাঁর তো বটেই ভারতের আধুনিক শিল্পচর্চার ইতিহাসে অন্যতম কাজ। জাপান গিয়েছিলেন। সেখান থেকে দেখে আসা শিল্পরীতির এদেশে প্রয়োগ করেন তিনি।বিনোদবিহারীর শ্রেষ্ঠ কাজগুলোর ভেতর পড়ে তাঁর ম্যুরালগুলো।
''স্ক্রোল পেন্টিং'' ও ''চাইনিজ স্কেচ'' রীতি শুরু করেন। তাঁর সৃষ্টিতে বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে ফুল। খুব অসাধারণ কোনও ফুল নয়, যা আমাদের চারপাশে যা দেখা যায় সেইসব দোলনচাঁপা, মধুমালতী, পদ্ম। তিনি ফুল চিনতেন স্পর্শ দিয়ে, গন্ধ দিয়ে। ফুলের গন্ধ তাঁর কাছে উপস্থিতির আশাবাদ হয়ে ধরা দিত। ব্যক্তিগত একাকিত্বকে ধরেছিলেন ক্যানভাসে।
জীবন যে রুক্ষরূপ তাঁকে দেখিয়েছিল, তিনি তাকে পরম মমতায় বদলে দিয়েছিলেন রঙে-রেখায়। সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়েই এক গভীর প্রশান্তি যা কেবল একাকিত্ব এনে দিতে পারে তেমন বোধকে উন্মোচন করেছেন শিল্প চর্চার মাধ্যমে।
কবিগুরু তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সেখানে এসেই জীবন মোড় নিয়েছিল শিল্পের বাঁকে। আজীবন তাই শান্তিনিকেতনকেই নিজের জীবনের অঙ্গ করেছিলেন।
নিয়তি নির্দিষ্ট পথে এগিয়েও সৃষ্টি শাশ্বত পথে আত্ম অনুসন্ধান করে গিয়েছেন। যা এক শিল্পীর আমৃত্যু সাধনার ধন।