প্রথম ভারতীয় ভূ-পর্যটক বিমল মুখোপাধ্যায়

শঙ্কর রায়চৌধুরী, মনমোহন মিত্র আর বিমল মুখোপাধ্যায়। এই তিন ভদ্রলোকের মিল কোথায় বলতে পারেন?

আপনি হয়ত এক কথায় বলবেন ‘তিনজনেই বাঙালি’। আর একটু ভেবে দেখলে বলবেন, শঙ্কর রায়চৌধুরী ‘শঙ্কর’ আর মনমোহন মিত্র সত্যজিতের ‘আগন্তুক’। দুজনেই ভূ পর্যটক। একজন ঘর ছেড়েছিল আফ্রিকার টানে অন্যজন আলতামিরার বাইসনের টানে। তৃতীয় বাঙালি বিমল মুখার্জী বা বিমল মুখোপাধ্যায়।  তাঁকে  হয়ত আজ আর বাঙালি চিনবে না। অথচ একদিন এই বাঙালির জন্য উৎসবে মেতেছিল তাঁর শহর কলকাতা। কুর্নিশ জানিয়েছিল গোটা পৃথিবী। প্রথম ভারতীয় ভূ-পর্যটক এই বাঙালিকে।     

জন্ম ১৯০৬ সালে ওড়িশায়। কলকাতার পটলডাঙা স্টিটে আদি বাস। পরে তিনি দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জের বাসিন্দা। বাঙালি ঘরমুখো, কুনো, ভীতু এই ধারণাকে রাতারাতি বদলে দিয়েছিলেন মানুষটি। 

bimal mukherjee

প্রায় এক যুগের ওপর সময় লেগছিল তাঁর। ১৯২৬ থেকে ১৯৩৭ টানা। খরচ আসত পথ থেকেই। কখনও তিনি ফটোগ্রাফার। কখনও তিনি নাবিক, কখনও পাইলট। তাঁর সাময়িক পেশার লিস্ট এখানেই শেষ হয়ে যায় না। দেশ দেখার খরচ জোগাড় করতে গিয়ে কখনও কখনও ডেয়ারি ফার্মে কাজ নিয়েছেন। আবার কখনও মাছ ধরার ট্রলারে। স্কুল কলেজে অতিথি বক্তা হিসেবে লেকচারও দিয়েছেন।

এতরকম ভাবে অর্থ উপার্জন করেছেন যে মাঝে মাঝে তাঁর মনে হত এক জীবন না, আসলে বহুবার জন্ম হয়েছে তাঁর, বহু জীবনে বাস করেছেন।

অর্থ ছাড়াও উপার্জন করেছেন অভিজ্ঞতা। মানুষের সঙ্গে মিশতে গিয়ে মনের দরজা-জানলাগুলো খুলে গিয়েছে। আলো বাতাস খেলতে পেয়েছে।

ঘর ছেড়েছিলেন। টানা বারো বছর ঘরের সঙ্গে যোগাযোগ বলতে শুধু চিঠি। প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখতেন মাকে। কখনও ভুল হত না। চিঠিতে ধরা থাকত দেশ দেখার গল্প।

১৯২৬ সাল। কলকাতায় শীত নেমেছে। ডিসেম্বরের আমেজ গায়ে মেখে রোদ পোহাচ্ছে শহরবাসী। ঠিক তেমনি এক দিনে ঘর ছাড়লেন বছর তেইশের এক যুবক। সঙ্গে তিন বন্ধু। অশোক মুখোপাধ্যায়, আনন্দ মুখোপাধ্যায়, আর মণীন্দ্র ঘোষ। চার বাঙালির  সঙ্গী দু’চাকার চার বিশ্বস্ত বাহন।

সেই নিয়েই তাঁরা পা বাড়ালেন অচেনা অনিশ্চিতের দিকে। চার বাঙালির দেশ দেখতে বের হওয়ার খবর বেশ হইহই ফেলেছিল শহরে। ১২ ডিসেম্বর টাউন হল থেকে শুরু হল যাত্রা। প্রচন্ড উদ্দীপনা মানুষের মধ্যে। টাউন হলের সামনে জনসমুদ্র।

কলকাতা থেকে হাওড়া হয়ে সাইকেল চলল জিটি রোডের দিকে। দু’পাশে মানুষের পর মানুষ। ঘরকুনো বাঙালির বদনাম ভেঙে চার বাঙালি ছেলে সাইকেলে বিশ্বজয় করতে চলেছে এই বিষয়টি যেন প্রতিটি বাঙালির ব্যক্তিগত গর্বের বিষয় হয়ে উঠেছিল সেদিন।

কলকাতা ছাড়িয়ে জেলায় প্রবেশ করলেও তাঁরা স্পর্শ করতে পারছিলেন তাঁদের ঘিরে সাধারণ মানুষের  উন্মাদনা। এসব সত্বেও বুকের গভীরে কোথাও যেন চিনচিন করছিল ঘরছাড়ার টান।

বিমল মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “মাকে ভীষণ ভালোবাসতাম। বিদায়ক্ষণে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন।” এমন টান তাঁদের সকলের মধ্যেই কমবেশি ছিল। কিন্তু পথের টানও বড় প্রবল।

সাইকেলের পিছনে সাঁটা একটা বড় স্টিলের ট্র্যাঙ্ক। চাবি দিয়ে বন্ধ। তার মধ্যে পথের সংসার। কাঁধের হ্যাভারস্যাকে ভর্তি জিনিস। ক্যামেরা থেকে বন্দুক-কার্তুজ কী নেই সেখানে!

জিটি রোড ধরে সাইকেল ছুটল রাঁচি, পালামৌ, বেনারস হয়ে নয়াদিল্লির পথে। সেখানে তাঁরা সাক্ষাৎ করেছিলেন আর এক বিখ্যাত বাঙালির সঙ্গে। তিনি ডঃ সত্যরঞ্জন দাশ। এদেশে তখন ইংরেজ রাজ চলছে। ডঃ সত্যরঞ্জন দাশ ভাইসরয় আরউইনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন চার অভিযাত্রীর। সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। স্যার উইলিইয়াম বার্ডউডও ছিলেন অন্যতম উৎসাহদাতা। সেই সূত্রেই ভারত থেকে কন্সট্যান্টিনোপল পর্যন্ত পথে যাতে কোনও বিপদে পড়তে না হয় সে বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন তদানীন্তন বিদেশ সচিব স্যার জন হেনস।

এই বাঙালি অভিযাত্রী দলের প্রথম বিদেশ করাচী। করাচী আজ বিদেশ হলেও মনে রাখতে হবে তখনও দেশভাগ হয়নি। হায়দ্রাবাদ হয়ে তাঁরা এগিয়েছিলেন করাচীর পথে। তারপর মেসোপটেমিয়া, ইরাক, ইরান, সিরিয়া, ভিয়েতনাম, মিশর, ব্রিটেন, ফিনল্যান্ড, পেরু, তাঞ্জানিয়া, জাপান, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, সুইডেন আরও অনেক।

দেশের মাঝে নানা অচেনা জনপদ, মানুষ, জীবন, জল, জঙ্গল আর অজস্র অভিজ্ঞতার স্রোত। বারবার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে পরিস্থিতি। এগোতে হলে সামলাতে হবে সংকট। হার মানেননি এই চার বাঙালি যুবক। প্রবল পরাক্রমে মোকাবিলা করেছেন সব কিছুর।

পথ বদলে দিয়েছিল জীবন। শিখিয়েছিল প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে কোনও কিছুতেই জেতা যায় না। তাঁরা যখন গিয়েছিলেন তখন পাথেয় বলতে ছিল মানুষের শুভেচ্ছা। পৃথিবীর যে দেশেই পা রেখেছেন তাঁদের সাহস আর জেদকে সম্মান জানিয়েছে মানুষ। আতিথেয়তা দিয়ে আপন করে নিয়েছে তারা।

ফেরার পথটাও তাঁদের একই ছিল। সেই বর্ধমান, চন্দননগর, হাওড়া হয়ে কলকাতায় নিজের বাড়িতে। একযুগ পর। বাবা- মা পরিবারের সঙ্গে দেখা। গিয়েছিলেন শীতে, আর যখন ঘরে ফিরলেন তখন কলকাতায় বর্ষা ঢুকবে ঢুকবে করছে।

ঘরের ছেলের সঙ্গে দেখা করতে একদিন আগেই বালি শহরে এসে পৌঁছেছিলেন বিমল মুখোপাধ্যায়ের পরিবার। একযুগ পর কান্না আর অপেক্ষার অবসান হয়েছে রত্নগর্ভা মায়ের। তাঁর মুখে হাসি ধরে না…  

চার বিশ্বজয়ীকে উৎসব করে বরণ করে নিয়েছিল শহর। ১২ জুন ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে তাঁদের গণ সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। বহু বাঙালিকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলেন এই চার অভিযাত্রী। বদলে দিতে পেরেছিলেন পরবর্তী প্রজন্মের চিন্তাভাবনার ধারা।

বিমল মুখোপাধ্যায়ের মা তাঁকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, “তোমার জীবনের সব ঘটনা আমার কাছে ধরা আছে। ভ্রমণ শেষ করে লিখতেই হবে।” সেভাবেই কেটে যায় ৫০ বছর। অর্ধ শতক পর নিজের অভিজ্ঞতাকে লিপিবব্ধ করেছিলেন তিনি। সবুজ মলাটে ৩১৮ পাতার ‘দু’চাকায় দুনিয়া’ তাঁর দীর্ঘ যাত্রাপথের ফসল। সে বই তিনি উৎসর্গ করেছিলেন এই দেশের যুবকদের উদ্দেশ্য।       

 

তথ্যঋণঃ দু'চাকায় দুনিয়া 

 

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...